কুশল প্রশ্নোত্তরঃ ধ্যান সমাধি- ভদন্ত এস. ধাম্মিকা

ধ্যান-সমাধি
প্রশ্নঃ- ধ্যান-সমাধি বা ভাবনা কি?
উত্তরঃ ধ্যান-সমাধি বা ভাবনা হলো, মনের কার্যকলাপ উন্নয়নের সচেতন প্রচেষ্টা। পালি ভাষায় ভাবনা অর্থ হলো গড়ে তোলা। বা বৃদ্ধি করা।
প্রশ্নঃ- ধ্যানের তাপর্য কি?     
উত্তরঃ ধ্যান বা ভাবনার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যতই ভালো হতে চাই না কেন, তা সম্ভব হবে না, যদি আমাদের মনে স হবার সদা সচেতন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা না হয়। উদাহারণ স্বরুপ বলা যায়, নিজ স্ত্রীর প্রতি অসহনশীল স্বামী প্রতিজ্ঞা করলেন, এখন থেকে তিনি স্ত্রীর প্রতিসহনশীল হবেন। কিন্তু পরমুহুর্তে স্ত্রীর সঙ্গে চেঁচামেচি শুরু করলেন। এর কারণ তার কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি মনকে প্রহরীর মত সদাসচেতন রাখেননি। ফলে তাঁর অজ্ঞাতেই তিনি ধৈয্য হারিয়ে ফেলেছেন। ভাবনা বা ধ্যান-সমাধি নিজের মনের উপর প্রহরীর মত সদা সচেতন থাকার শক্তি ও অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
প্রশ্নঃ- আমি শুনেছি, ধ্যান কখনো কখনো বিপদজ্জনক হতে পারে; তা কি সত্য?     
উত্তরঃ এর উত্তর এভাবে দেয়া যায়। বাঁচার জন্য আমাদের লবনের প্রয়োজন। কিন্ত আপনি যদি একসঙ্গে ১ কিলোগ্রাম লবন খেয়ে ফেলেন, তাহলে আপনার মৃত্যু ঘটবে। আধুনিক জীবন যাপনের জন্য গাড়ী প্রয়োজন। কিন্তু আপনি যদি ট্রাফিক আইন না মেনে গাড়ী চালান, তাহলে আপনার বিপদ হবে। ধ্যান-সমাধি বা ভাবনাও তদ্রুপ। আমাদের ধ্যান অনুশীলন প্রকৃত সুখ-শান্তির জন্য অপরিহায্য, কিন্তু সঠিকভাবে চর্চা না করলে সমস্য দেখা দিবে। অনেকের ভুল ধারণা হলো মানসিক চাপ, অমূলক ভীতি এবং স্কিজোপ্রেনিয়ার মতো অসুখ ধ্যান অভ্যাসে নিরাময় হয়। এই জাতীয় অসুখে প্রথমে বিশেষজ্ঞ চিকিসকের চিকিসা নেয়া উচিত। কিছুটা সুস্থ হবার পর ধ্যান অভ্যাস শুরু করতে হয়। শুরুতে অনেকক্ষণ ধ্যান করলে ক্লান্তি আসে। ক্যাঙারু ধ্যান আরও ক্ষতিকর। এই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে, কখনও নিজে বই পড়া পদ্ধতিতে ক্যঙারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ঘন ঘন পদ্ধতি পরিবর্তন করে ধ্যান চর্চা করলে ক্ষতি হয়। কোন জটিল মানসিক রোগ না থাকলে ধ্যান সমাধি বা ভাবনা মানসিক উকর্ষ সাধনে অশেষ উপকার সাধন করে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আধুনিক চিকিসা বিজ্ঞানীদের মতে অনেক শারিরীক রোগ মানসিক কারণে সৃষ্টি হয়।
প্রশ্নঃ-  কত প্রকার ধ্যান পদ্ধতি আছে?    
উত্তরঃ বুদ্ধ বিভিন্ন পদ্ধতির ধ্যান শিক্ষা দিয়েছেন। এক পদ্ধতি এক রকম মানসিক সমস্যার সমাধান ও মানসিক উকর্ষ সাধনে সাহায্য করে থাকে। তবে দুপ্রকারের ধ্যান পদ্ধতি সব চাইতে বেশী উপকারী। এর একটি হলো সচেতন শ্বাস-প্রশ্বাস ভিত্তিক অর্থা আনাপানা স্মৃতি, অন্যটি হলো মৈত্রী ভাবনা বা মেত্তা স্মৃতি।
প্রশ্নঃ- আনাপানা পদ্ধতি কিভাবে করতে হয়?
উত্তরঃ আপনি পি অক্ষর দিয়ে শুরু  চার শব্দের চারটি সহজ ধাপে ধ্যান করতে পারেন। যেমন, প্রথম ধাপে প্লেস বা স্থান নির্বচন; এমন স্থানে বসে ধ্যান করতে হবে, যেখানে কোন গোলমাল নেই। দ্বিতীয় ধাপে পজিশন বা শরীরের অবস্থান-আরামদায়ক স্থানে হতে হবে। হাটু ভাঁজ করে আরামে কোলের উপরে বাম হাতের তালুর উপর ডান হাতের তালু রেখে, শির দাড়া (মেরুদন্ড) সোজা রেখে চোখ বন্ধ করে আসন নিন। এর বিকল্প অবস্থান হতে পারে চেয়ারে শিরদাড়া সোজা রেখে বসা। পা থেকে মাথার তালু পযর্ন্ত, নীচ থেকে উপরের দিকে পয্যায়ক্রমে প্রত্যক গিট, মাংসপেশী শিথিল করে আসন নিতে হবে। তৃতীয় ধাপে প্রাকটিস বা আসল ধ্যানানুশীলন- এতে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শ্বাস ছাড়া(বিলয়) এবং শ্বাস নেয়া (উদয়) এর মধ্যে মনঃসংযোগ করা। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নাভির ওঠানামার মধ্যে অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে মনঃসংযোগ রাখতে পারেন। চতুর্থ ধাপে পোবলেম বা ধ্যানের সময় মনঃসংযোগে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন-শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুলকানী অনুভব, হাটুতে ব্যাথা দেখা দিতে পারে। এতে নড়াচড়া না করে, অস্থির না হয়ে, যে জায়গায় চুলকাচ্ছে বা ব্যাথা করছে সেই হাটু বা স্থান শীথিলভাবে রাখার অনুভুতি আনতে হবে। কোথাও চুলকানো অপরিহায্য হলে মনঃসংযোগ সহকারে হাত তোলা, নেয়া, চুলকানো, আবার হাত যথাস্থানে ফিরিয়ে আনা, সবই মনঃসংযোগ সহকারে করতে হবে এবং যথাশীঘ্র পুনরায় নাভি ওঠানামার মধ্যে মনঃসংযোগ ফিরিয়ে আনতে হবে। এছাড়া অস্থির মন বিক্ষিপ্তভাবে এখানে-সেখানে, এবিষয় ওবিষয়ে ছোটাছুটি করে। তখন ধৈয্যের সাথে তড়াহুড়া না করে, মনঃসংযোগ যথাশীঘ্র নাভির ওঠনামার মধ্যে বারবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবে অনুশীলন করতে করতে, অনুশীলন অব্যাহত রাখলে ক্রমান্বয়ে অস্থির-বিক্ষিপ্ত চিত্ত বা ছোটাছুটি করা মন স্থির হয়ে আসবে, মনঃসংযোগ শক্তিশালী হয়ে ওঠবে এবং মনের গভীরে প্রশান্ত মুহুর্ত গুলোর উদয় হবে। এক কথায় আপাদমস্তক দেহ প্রশান্ত শীথিলতায় উপবিষ্ট আসনে অথবা শয্যায় সমর্পিত করে মনকে দেহের মধ্যে সংযুক্ত করে। দেহ মনের এ গতিবিধি পয্যবেক্ষণের নাম ধ্যান, ভাবনা বা সমাধি।
প্রশ্নঃ- কতক্ষণ ধ্যান করা উচিত?   
উত্তরঃ প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন ১৫ মিনিট। তারপর প্র্রতি সপ্তাহে ৫ মিনিট করে বাড়াতে থাকুন। এভাবে প্রতি দিন ৪৫ মিনিট করে ধ্যান্ভ্যাস এবং নিয়মিত ধ্যানানুশীলন করলে অনুভব করবেন আপনার মনসংযোগের সময়সীমা বৃদ্ধিলাভে মনের বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটি, অস্থিরতা হ্রাস পাচ্ছে, ক্রমান্বয়ে আপনি মনের ও শরীরের শিথিল, প্রশান্ত অনুভূতিপূর্ণ মুহুর্তের সন্ধান পাচ্ছেন।
[*** আপনি যদি এমন ব্যক্তির সন্ধান পান, যিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টিনিয়ে আপনার ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করতে আগ্রহী সেই ব্যক্তিই আপনার কল্যাণমিত্র।]
প্রশ্নঃ- মেত্তাভাবনা ধ্যান কিভাবে করতে হয়?
উত্তরঃ আনাপানা পদ্ধতির ধ্যানাভ্যাস রপ্ত হবার পর মেত্তাভাবনা পদ্ধতির ধ্যান শুরু করতে হয়। আনাপানা পদ্ধতিতে ধ্যান করার পর মেত্তভাবনা পদ্ধতি শুরু করবেন। এটি সপ্তাহে ২/৩বার করতে পারেন। এই পদ্ধতি হলো- প্রথমে নিজের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলুন, আমি যেন ভালো থাকি, সুস্থ থাকি, ধীর-স্থির থাকি, বিপদমুক্ত, রোগমুক্ত ও শত্রুমুক্ত হই; আমার মন দ্বেষমুক্ত হোক, অন্তর মৈত্রী-করুণাময় হোক। এরপর অনুরুপ মঙ্গল কামনা প্রথমে আপনার প্রিয়(বাবা-মা, শিক্ষাগুরু, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী) ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে, তারপর নিরপেক্ষ (আপনার প্রিয়ও নয় অপ্রিয়ও নয়) ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে, সবশেষে আপনার পছন্দ নয় এমন ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে করুন। মনে মনে বলুন, এরা সবাই যেন নিজের মতো সুখে-শান্তিতে বসবাস করেন।

প্রশ্নঃ- মেত্তভাবনার উপকারীতা কি?
উত্তরঃ আপনি আন্তরিক অনুভূতি নিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করলে, নিজের মধ্যে প্রশান্তিময় এক শুভ চেতনা অনুভব করবেন। দেখতে পাবেন, আপনি সবার কাছে ক্রমশঃ গ্রহণযোগ্য, ক্ষমাশীল হয়ে উঠেছেন, আপনার প্রিয় ব্যক্তিদের প্রতি আপনার ভালবাসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাদের প্রতি আপনি উদাসীন ছিলেন, আপনার ক্ষোভ ও বৈরীভাব ছিল, তাদের প্রতি অকুশল ভাব হ্রাস পেয়ে করুণা-উপেক্ষা-মৈত্রী ভাবের উদয় হচ্ছে। এসনকি গভীর মনোসংযোগের ধ্যানে কোন রোগীকে অন্তঃর্ভূক্ত করলে রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটবে।

প্রশ্নঃ- ঐ ব্যাপারটি কিভাবে সম্ভব হয়?
উত্তরঃ মনকে সম্যকভাবে ধ্যানের একাগ্রতায় সংগঠিত করতে সফল হলে, মন এক শক্তিশালী যন্ত্রের মত শক্তি সঞ্চয় করে। মনের ঐ শক্তিকে অন্যের প্রতি যথার্থভাবে প্রয়োগ করতে সফল কাম হলে তা কায্যকরী হয়ে উঠে। আপনার এমন অভিজ্ঞতাও থাকতে পারে, অনেক লোকের ভীড়ের মধ্যে আপনি অনুভব করছেন, কেউ আপনাকে লক্ষ্য করছেন। এর কারণ, আপনার মননশক্তি ঐ ব্যক্তির গ্রাহক যন্ত্র হিসেবে কাজ করছে। এটি মেত্তাভাবনার প্রভাব যা ভাবনাকারী পয্যবেক্ষণ করবেন।

প্রশ্নঃ- ধ্যান শিক্ষার জন্য কি কোনও শিক্ষকের প্রয়োজন?
উত্তরঃ শিক্ষক অপরিহায্য নয়। তবে অভিজ্ঞ ব্যক্তির নির্দেশ অবশ্যই সাহায্য করে। দুর্ভাগ্য বশতঃ অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া যায় না। ভালভাবে অনুসন্ধান করে প্রশিক্ষক নির্বাচন করা উচিত। তা না হলে বিপরীত ফল হতে পারে।
প্রশ্নঃ- শোনা যায় মনস্তত্ববিদ কিংবা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি তাদের কাজে ধ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করছেন; একথা কি সত্য?
উত্তরঃ কথাটি সত্য। সম্প্রতি রোগ চিকিসায় ধ্যান-পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বিশেষতঃ আত্মসচেতনতা সৃষ্টি, অমূলক ভীতি দূরীকরণ কিংবা দুচিন্তাগ্রস্থ রোগীর প্রশান্তি প্রদানের জন্য। বুদ্ধের আবিষ্কৃত বিশ্লেষনধর্মী মনের তথ্য অদ্যাবধি মানুষকে অজ্ঞানজনিত দুঃখ থেকে মুক্তি দিয়ে অপ্রমেয় শান্তি প্রদান করে যাচ্ছে।
[*** যে ব্যক্তি অন্যকে সশিক্ষার উপদেশ দেন এবং অকুশল কর্ম থেকে বিরত রাখেন তিনি সলোকের প্রিয় ও অসলোকের বিরাগভাজন হন।]
[*** যিনি অকুশল কর্ম করেছেন, তিনি যেন পুনর্বার তা না করেন, তিনি যেন কুশল কর্মে আনন্দ এবং অকুশল কর্মে দুঃখবোধ করেন।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন