এক জীবনে বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর এবং…

অছ্যু পরিবারে পিতা রামজী মালোজী শকপাল ও মাতা ভীমাবাঈ-এর ১৪ সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন আম্বেদকর পারিবারিক নাম ভীমরাওযদিও চৌদ্দজন ভাই বোনের মধ্যে ৫ জন বেঁচে ছিলেন, ভাই ২ বোনবলরাম, আনন্দরাও, মঞ্জুলা, তুলসী ও সর্বশেষ ভীমরাওপৈতৃক বাড়ী ছিল কালীন বোম্বাই প্রদেশের রত্নগিরি জেলার আম্বেদাবাদ গ্রামেপিতা রামজী শকলাল মধ্যপ্রদেশের মোউসেনানিবাসে চাকুরিকালীন সময়ে ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল আম্বেদকরের জন্মপুত্রের নাম রাখা হলো ভীমরাও শকপালআম্বেদকর হলো পার্শ্ববর্তী এক গাঁয়ের নামস্কুলজীবনে প্রবেশের পর এক ব্রাহ্মণ শিক কৌতুহলবশত শকপালের স্থলে ভীমরাও এর সাথে জুড়ে দেন আম্বেদকর শব্দটিসেই থেকে ভীমরাও শকপাল হয়ে গেলো ভীমরাও আম্বেদকরতাঁর পূর্বপুরুষদের অনেকেই ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেনতাঁর পিতামহ মালোজী শকপালও সৈনিক ছিলেনথানা জেলার অন্তর্গত মুরবাদ গ্রামের মুরবাদকর পরিবারের তাঁর মাতামহরাও ছিলেন সামরিক বাহিনীর সুবেদার-মেজর

পিতা রামজী শকলাল মারাঠি ও ইংরেজিতে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন বলে শিক্ষানুরাগ ও ধর্মপরায়নতা তাঁর চরিত্রের অংশ হয়ে উঠেছিলোফলে সন্তানদেরকে শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনিসাথে সাথে উসাহিত করতেন হিন্দু ধর্মের ক্লাসিকগুলো অধ্যয়নের জন্যসেনাবাহিনীর সুবেদার হিসেবে সামরিক বাহিনীর চাকুরি থেকে রামজী শকলাল ১৮৯৪ সালে যখন অবসর নেন তখন আম্বেদকরের বয়স সবে দুই বছর পেরিয়েছেএর দুবছর পরে রামজী বোম্বাই প্রদেশের সাতারার সেনাবানিবাসের একটি স্কুলে চাকুরি জোগাড় করে সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেনএরই মধ্যে আম্বেদকরের মাতা ভীমাবাঈ মারা গেলেনভীমাবাঈয়ের অকাল মৃত্যুতে শোকাভিভুত রামজী তাঁর একমাত্র বোন মীরাবাঈকে সংসার দেখাশুনার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে এলেনতিনি সাংসারিক কাজে খুব অভিজ্ঞ ও কর্মঠ ছিলেনইতোমধ্যে ১৮৯৮ সালে আম্বেদকরের বাবা রামজী শকপাল পুনরায় বিয়ে করেনআম্বেদকরের বয়স তখন ৫/৬ বসরপিতার এই দ্বিতীয় বিয়েকে আম্বেদকরের শিশুমন কিছুতেই মেনে নিতে পারেনিফলে অধিকাংশ সময় পিসীর সাহচর্যেই কাটাতেনমাতৃহারা আম্বেদকরকে তিনি মাতৃস্নেহে বেঁধে রাখতেন

ছেলের স্কুলে পড়ার বয়স হলে সেনাবাহিনীর চাকুরির সুবাদে বহু অনুনয় বিনয় করে রামজী শকলাল তার পুত্রকে সরকারি স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেলেনআম্বেদকরের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষাজীবন শুরু হলো সাতারাতেআর স্কুলজীবনের শুরুতেই হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী জাতিভেদ প্রথা তথা অস্পৃশ্যতার অভিশাপের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা শুরু হলো তাঁর

বাল্যকাল বা স্কুল জীবন থেকে প্রতি পদেক্ষেপে যেভাবে তিনি সামাজিক বঞ্চনা, নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হয়েছিলেন তখন থেকে তাঁর মধ্যে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার স্বপ্ন জাগ্রত হয়েছিলোতাঁর জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাগুলো তাঁকে অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে শক্তি যুগিয়েছে একসময় স্কুলে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার কারণে স্কুল এবং পড়াশুনার প্রতি ঘোর বিতৃষ্ণা জন্মে যায় এবং প্রায়শই স্কুল পালাতে থাকেন তিনিতবু লক্ষ্যকে তাঁর দৃষ্টি থেকে কখনো ফিরিয়ে নেননিএদিকে বিমাতাকে মোটেই সহ্য করতে পারছিলেন নাফলে কচি আবেগের বশবর্তী হয়ে তিনি এ পরিস্থিতিতে স্বাধীন জীবিকার্জনের কথা চিন্তা করে বোম্বাইতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেনকিন্তু সেখানে যেতে অনেক টাকা পয়সার প্রয়োজনতাঁর কাছে কোন টাকা পয়সা নেই অগত্যা পিসীমার কোমরে বাঁধা থলিটির দিকে ভীমের নজর পড়লে একদিন তা ভাগিয়ে নিয়ে থলিটিতে প্রত্যাশিত পয়সা না পেয়ে অতিশয় হতাশ হয়ে পড়েনআর এই সময়টাতেই তাঁর জীবনের আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়তাঁর কথা থেকেই জানতে পারা যায় যে, এই পরিবর্তনের কারণেই তিনি পরবর্তীতে নিজেকে ড. আম্বেদকর হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন- ‘ঠিক করলাম যে আমি স্কুল পালানোর অভ্যাস ত্যাগ করবো এবং পড়াশুনার প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করবো, যাতে যত শীঘ্র সম্ভব স্কুলের পাঠ সেরে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন শুরু করতে পারি’ এরই মধ্যে চাকুরির কারণে রামজী শকপাল সপরিবারে বোম্বাই চলে এলেনছোট্ট একটি ঘর ভাড়া নিলেন যা ৬/৭ জন সদস্যের পক্ষে কোনক্রমেই মাথাগোজা সম্ভব নয় আম্বেদকরকে মারাঠা হাইস্কুলে ভর্তি করানো হলো এবং স্কুলের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ পিতার সযত্ন শিক্ষাদানে তাঁর পড়াশুনায় প্রভূত উন্নতি দেখা দিলো অন্য ভাইদের পড়াশুনা আর না হলেও পিতা রামজী ভীমের পাঠস্পৃহা দেখে চরম অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর জন্য বিভিন্ন বইপত্র সংগ্রহ করে আনতেনপড়াশুনায় উত্তরোত্তর মনোযোগ ও উন্নতি লক্ষ্য করে তাঁকে বোম্বাইর বিখ্যাত স্কুল এলফিনস্টোন হাইস্কুলে ভর্তি করানো হলোআম্বেদকরই হলেন এলফিনস্টোন রোডের আশেপাশের এলাকায় এখানকার প্রথম ও একমাত্র অস্পৃশ্য ছাত্র

এই নামকরা স্কুলে ভর্তি হয়ে শত অবহেলা অপমানের মধ্যেও পড়াশুনার প্রতি তাঁর মনোযোগ আরো বেড়ে গেলোকিন্তু যে পরিবেশের মধ্যে তাঁকে পড়াশুনা করতে হয়েছে তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয় সবার জন্য একটিমাত্র ঘরসেখানে রান্নাবান্না, থাকা-খাওয়া, জ্বালানি কাঠের স্তুপ, ঘরের এক কোণে থাকতো একটি ছাগলও থাকার জায়গার অভাবে পিতা রামজী একটি কৌশল বের করলেনসন্ধ্যার পর আম্বেদকর ঘুমোতে যেত এবং পিতা রামজী জেগে থেকে তাঁর পাঠ তৈরি করে দিতেন রাত দুটো বাজলে তিনি আম্বেদকরকে জাগিয়ে তার জায়গায় শুয়ে পড়তেনআম্বেদকর সারারাত ধরে নিরিবিলিতে পড়াশুনা করতেনএকদিকে পারিবারিক অসুবিধা অন্যদিকে এলফিনস্টোন হাইস্কুলের মতো ঐতিহ্যবাহী স্কুলেও বর্ণহিন্দু সহপাঠী ও শিকদের কাছ থেকে লাঞ্ছনা ও বিষোদ্গার সত্ত্বেও ১৯০৭ সালে এলফিনস্টোন হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন

সে সময়কালে একজন অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায়ের ছেলের প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করা ছিলো অকল্পনীয় ব্যাপারবোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলফিনস্টোন কলেজে আইএ ক্লাশে আম্বেদকরই হলেন ভারতবর্ষের প্রথম কোন অস্পৃশ্য ছাত্রএই কৃতিত্বের জন্য তাঁর সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়, যার পৌরোহিত্য করেন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক এস.কে বোলে এবং সমাজসেবী শিক্ষক অর্জুন কেলুশকার, যিনি দাদা কেলুশকার নামে পরিচিতকৃতিত্বের জন্য উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও উচ্চশিক্ষার জন্য উসাহিত করে অর্জুন কেলুশকার প্রীতি উপহার হিসেবে গৌতম বুদ্ধেরএকটি জীবনী গ্রন্থ আম্বেদকরের হাতে তুলে দেন এই বইটিই পরবর্তীকালে আম্বেদকরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পট পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলো

সে আমলে অল্প বয়সে বিয়ের রেওয়াজ থাকায় প্রবেশিকা পাশ করার পর আম্বেদকরের আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর বিয়ের আয়োজন করা হলো দাপোলীর সগোত্রীয় সম্প্রদায়ের ভিখু ওয়ালঙ্করের নয় বছর বয়েসী কন্যা রমাবাঈয়ের সাথে ভীমরাও আম্বেদকর ১৯০৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হনএই রমণীর গর্ভে তাঁর তিন পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়কন্যা ইন্দু শৈশবেই মারা যায় এবং এক পুত্র রাজরত্ন ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে মারা যায়

১৯১০ সালে এলফিনস্টোন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করার পর অর্থাভাবে তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হবার খবর পেয়ে শুভানুধ্যায়ী শিক্ষক অর্জুন কেলুশকার আম্বেদকরকে নিয়ে বরোদার মহারাজা সয়াজিরাও গাইকোয়াড়ের সঙ্গে দেখা করেনসব শুনে মহারাজা তাঁর উচ্চশিক্ষা গ্রহণার্থে যাবতীয় সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন এবং তাঁকে একই কলেজে বি.এ পড়ার খরচ জোগান১৯১২ সালে সেখান থেকে বি.এ পাশ করেন এবং ঠিক তার পরের বছর ১৯১৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তাঁর পিতার মৃত্যু হয়তাঁর জীবনের অন্যতম সহায়ক শক্তির উস পিতার মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত শোকাভিভূত হয়ে পড়লেও বর্ণবাদের শিকার হয়ে শৈশবের অপমান, নির্যাতন, অবজ্ঞা, অত্যাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে অধিকার অর্জনের সংগ্রাম তাঁকে সর্বদাই তাড়িত করছিলোআর এ শুধু তাঁর নিজের অধিকার আদায়ের লড়াই নয়, শত সহস্র বছরকাল ধরে নির্যাতিত, শোষিত, লাঞ্ছিত কোটি কোটি অস্পৃশ্য মানব সন্তানদের মানুষ হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাঁচার লড়াইতা করতে হবে সেই কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিটার সাথে যারা বিদ্যা, বুদ্ধি, ক্ষমতা, অর্থ, কূটনীতি, ধূর্ততায়, শঠতায়, হিংস্রতায়, ধর্মান্ধতায় বহুগুণ শক্তিশালীএদের সাথে লড়তে হলে প্রথমে নিজেকে সেভাবেই যথোপযুক্তভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হবেএই প্রস্তুতির জন্য চাই যতো বেশি সম্ভব জ্ঞানবলে বলীয়ান হওয়াজীবনের এ পর্যায়ে এসে আম্বেদকর যে আর দমবার পাত্র ননতিনি দমে যাননি

দক্ষিণা বিশুদ্ধি

  • যে শীলবান ব্যক্তি ধর্ম্মদ্বারা লদ্ধবস্তু উদার কর্ম্মফল শ্রদ্ধা করিয়া সুপ্রসন্নচিত্তে দু:শীলকে দান করে সে দক্ষিণা দায়কদ্বারা বিশুদ্ধ হয়।
  • যে দু:শীল অধর্ম্মদ্বারা লদ্ধ দ্রব্য উদার কর্ম্মফল শ্রদ্ধা না করিয়া অপ্রসন্ন চিত্তে শীলবানকে দান করে সে দক্ষিণা প্রতি গ্রাহক হতে বিশুদ্ধ হয়।
  • যে দু:শীল অধর্ম্ম দ্বারা লদ্ধ দ্রব্য উদার কর্ম্মফল শ্রদ্ধা না করিয়া অপ্রসন্নচিত্তে দু:শীলকে দান করে আমি বলি সে দান বিপুল প্রদান করে না।(কারণ তাহা অবিশুদ্ধ)
  • যে শীলবান ব্যক্তি ধর্ম্মদ্বারা লদ্ধবস্তু উদার কর্ম্মফল শ্রদ্ধা করিয়া সুপ্রসন্নচিত্তে শীলবানকে দান দিয়া থাকে,আমি বলি সে দান িনশ্চয়ই বিপুলফল প্রদান করিয়া থাকে (কারণ তাহা দায়ক ও প্রতিগ্ গ্রাহক উভয় দ্বারা বিশুদ্ধ হয়)।
  • যে শীলবান ব্যক্তি ধর্ম্মদ্বারা লদ্ধবস্তু উদার কর্ম্মফল শ্রদ্ধা করিয়া সুপ্রসন্নচিত্তে দু:শীলকে দান করে সে দক্ষিণা দায়কদ্বারা বিশুদ্ধ হয়। 

        সূত্র : রত্নমালা, পৃ.৩২৭-৩২৯

বৌদ্ধধর্ম বিশ্বমৈত্রীর ধর্ম

লেখক : বুদ্ধানন্দ মহাথেরো 
উপাধ্যক্ষ, আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার, ঢাকা।

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৈশাখী পূর্ণিমার শুভ তিথিতে মঙ্গলময় ভগবান বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ। এই ত্রিস্মৃতিবিজড়িত সমুজ্জল দিনটি বৌদ্ধদের জন্য অতি পবিত্র দিন হিসেবে সুপরিচিত। মহামানব গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব এক অবিস্মরণীয় ঘটনা, যাঁর বিমল আধ্য জ্যোতিতে একদিন সমগ্র ভারত প্রদীপ্ত হয়েছিল। সম্রাট অশোক, কণিষ্ক প্র্রভৃতি রাজন্যবর্গ এবং সঙ্ঘের সদস্য ভিক্ষুগণ সেই আলোকবর্তিকা নিয়ে বহির্বিশ্বকেও আলোকিত করেছিলেন, যার ফলে চীন, জাপান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া, ভুটান প্রভৃতি দেশসহ বিশ্বের এক বৃহত্তর ভূভাগ এখন দেদীপ্যমান।
বৈশাখী পূণিমা উপলক্ষে ১৩৪২ বঙ্গাব্দে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অকুন্ঠ শ্রদ্ধাভরে বলেছেন, আমি যাকেঁ অন্তরের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলদ্ধি করি, আজ এই বৈশাখী পূণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি।কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্তরে ‌‌‌যাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলদ্ধি করেছিলেন , তিনি হলেন মহামানব গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধের প্রতি কবির অন্তরের অকৃত্রিম আকর্ষণ ও দুর্বলতার পরিচয় মেলে বুদ্ধ এবং বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত তাঁর প্রবন্ধে, সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে, গানে ও কবিতায়। বৌদ্ধধর্ম নিরীশ্বরবাদী, কিন্ত রবীন্দ্রনাথ জীবনের বৃহত্তম অংশেই ঈশ্বরে অস্তিত্মের প্রত্যয়ে সুস্থিত ছিলেন। আসলে বৌদ্ধধর্মের নৈতিক আদর্শ রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। এই আদর্শ তিনি সর্বান্ত:করণে গ্রহণ করেছিলেন।
বৌদ্ধধর্মে মানুষের হৃদয়বৃত্তিকেই বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মানুষের মধ্যে যে শ্রেয়বোধ কল্যাণশক্তির মহিমা নিহিত রয়েছে, তাকে উদ্বুদ্ধ করাই বৌদ্ধধর্মের প্রধান লক্ষ্য। আর রবীন্দ্রনাথ সেটাই উপলদ্ধি করেছেন। বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে সত্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই।  সত্যই সবচেয়ে শক্তিপ্রদ ও কল্যাণকর। মহামানব বুদ্ধ সব সময় চারটি বিষয়ে সর্বপেক্ষা গুরুত্ব দিয়েছেন তা হল-মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও  উপেক্ষা। এ চারমৈত্রী ধ্যানে বুদ্ধ সতত বিরাজমান থাকতেন।
মানব ইতিহাসের গতিধারায় ধর্মের প্রবর্তনা জীবন ও জগতকে সুন্দর ও মহিয়ান করে গড়ে তোলার জন্য। এ লক্ষ্যে বৌদ্ধধর্ম এক অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সমুজ্জল। মানবের বন্ধনমুক্তির স্বাদ, স্বাধীন চিন্তার হিরণ্ময় প্রকাশ। বিশ্বজনীন অনুভূতির বিপুল ঔদার্য এবং সাম্য-মৈত্রী- করুণার অমৃতময় বাণীতে সমৃদ্ধ বৌদ্ধধর্ম দেশ-কালের সীমারেখা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে অপূর্ব মহিমায়। জীবন ও জগত সম্পর্কে তথাগত বুদ্ধের অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, করুণা এবং আধুনিক চিন্তাচেতনার কারণেই বিশ্বের অধিকংশ জনগোষ্ঠী বৌদ্ধধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্তচিত্তে নিজেকে সম্পন্ন করেছিল।
বুদ্ধ ঈশ্বর কিংবা দেবতার দোহাই দিয়ে ধর্ম প্রচার করেননি। তিনি সম্পূর্ণ আত্মশক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। অন্যদেরও পরনির্ভরশীল না হয়ে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য বলেছিলেন। প্রফেসর বিডস ডেভিড বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বৌদ্ধধর্মে সর্বপ্রথম এমন এক মুক্তির বাণী ঘেষিত হয়েছে, যে মুক্তি প্রত্যেক মানব ইহলোকে জীব্দ্দশাতেই অর্জন করতে সক্ষম। এর জন্য ঈশ্বর কিংবা ছোট-বড় কোন দেবতার সহায়তা বিন্দুমাত্রও প্রয়োজন নেই। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আমরা দেখতে পাই, বুদ্ধের সমকালীন ভারতে বেতের বিকৃত ব্যাখ্যা ও ব্রহ্মণদের নিষ্ঠাহীন আচারসর্বস্ব ক্রিয়াকলাপ সাধারণ মানুষকে তমাচ্ছন্ন করে সত্যের জগত থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্ত আজন্ম আলোক পিয়াসী মানুষের চিত্ত খুঁজে মরছিল সত্য-সন্ধানীর পথের। ধূলায় অবলুণ্ঠিত মানবাত্মার ক্রন্দন ধ্বনিতে ভারী হয়ে উঠেছিল আকাশ-বাতাস। অসহ্য অবস্থার সেই দু:সহ বেদনার ক্রান্তি লগ্নে মানবিকতার নবমূল্যায়ন ও নবজাগৃতির বলিষ্ঠ কণ্ঠ  সোচ্চার হয়ে উঠেছিল মহামানব বুদ্ধের মুখ:নিসৃতি বাণীতে তথা বৌদ্ধধর্মে।
মহাকারুনিক তথাগত মনগড়া কোন কথা বলেননি। তাঁর প্রত্যেকটি বাক্যে যুক্তি রয়েছে। অনর্থক যুক্তিহীন কোন কথা বলে সময় ক্ষেপন করেননি ।
বৌদ্ধধর্ম যে আধুনিক মনে স্থান পেয়েছে, তার কারণ এটি অভিজ্ঞতা প্রসূত এবং কোন মতবাদের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়। জ্ঞান-কর্ম- প্রেমের প্রদীপ শিখায় উদ্দীপ্ত এবং উদ্ভাসিত হয়েছিল অবজ্ঞাত অবমানিত মানুষ। বহু কণ্ঠে যেন গেয়ে উঠেছিল- আজ আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।/ আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও। এতদিন পরে, বহু ঘুণেধরা সংষ্কারাচ্ছন্ন জীবনধারায় প্রাণগঙ্গার স্রোতধারায় প্রবাহিত হয়ে নতুন জীবনের স্বাদ পাইয়ে দিল।পরিপূর্ণ আনন্দে অবগাহনে দেহমনের যে প্রশান্তিময় তৃপ্তির স্বাদ ঠিক এখানেই। এ নতুনের কথা শুধু ভারতে কেন, বোধহয় তকালীন বিশ্বে এমন বলিষ্ঠরুপে এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে একমাত্র বুদ্ধের প্রবর্তিত ধর্মেই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। প্রতিটি মানুষই চায় ব্যক্তি স্বাধীনতা।  নিজস্ব সীমারেখা অতিক্রম করে অসীমের বিপুলের পথিক হতে। কিন্তু অতীতে সমাজবদ্ধ মানুষের চাপিয়ে দেওয়া রলাকাচার কুসংষ্কার সে যাত্রপথে বাধা সৃষ্টি করে নিজ গন্ডিতে আবদ্ধ রাখতে চায়। অহিংসামন্ত্রে উদ্দিপ্ত সাম্য-মৈত্রী-করুনার বাণী নির্বাণ সমৃদ্ধ অপূর্ব ধর্মাদর্শ, জাতিভেদহীন সবর্মানবিক মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের ক্ষমতা এবং অন্যায়-অত্যচারের বিরুদ্ধে প্রচন্ড আন্দোলনের বাণী বিশ্ববাসীকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে বৃহত ও মহতের মধ্যে পরম অমৃতকে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধধর্ম ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ নতুন পথে।
তথাগত বুদ্ধ সবসময় সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে ছিলেন। তিনি গভীর উপলদ্ধি দিয়ে যা ভাবতেন, সে ভাবনায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এমনকি রাষ্ট্রের সীমারেখাকে অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ডের সব মানবজাতি থেকে শুরু করে দেবতা, ব্রহ্মা থেকে শুরু করে ইতরপ্রাণী পর্যন্ত সমানভাবে স্থান পেয়েছে। তাই তো বুদ্ধ বলেছেন -‌‍‌‍‍ 'মাতা যথা নিযং পুত্তং আয়ুসা একপুত্ত মনুরকখে/ এবম্পি সব্বভূতেসূ মানসম্ভাবয়ে অপরিমাণং।' এর মর্মার্থ হলো, মাতা যেমন সন্তানকে আপন জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসেন, তদ্রূপ জগতের সব জীবের প্রতিও অনুরুপ দয়া ও মৈত্রী প্রদর্শন করবে। যেসব প্রাণী কাছে. যেসব প্রাণী দূরে অতি দূরে অবস্থান করছে, যেসব প্রাণী ছোট, বড়, ক্ষুদ্র, বৃহৎ, যেসব প্রাণী দেখা যায়, যেসব প্রাণী দেখা যায় না এবং যারা জন্মগ্রহণ করেছে, যারা জন্মগ্রহণ করবে- সবাই সুখী হোক। এ ধরণের কুশল চিন্তাকেই বুদ্ধ মৈত্রী ভাবনা বলেছেন। এ রকম ভাবনা অন্য কোন ধর্মে সাধারণত দেখা যায় না। বস্তুতপক্ষে বৌদ্ধধর্মে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বেশিষ্ট্য হলো বিশ্বব্যাপী প্রেমের অনুশাসন।  বৌদ্ধধর্ম সব সময় যুক্তিনির্ভর এবং বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া একে বিজ্ঞান সম্মত ধর্মও বলা হয়ে থাকে। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানীক আইনস্টাইন বলেছেন, আধুনিক বৈজ্ঞানীক মনের গ্রহণীয় যদি কোন ধর্ম থাকে, তা বৌদ্ধধর্ম।
তথাগত বুদ্ধ যে ধর্ম জগতের কল্যাণে প্রচার করেছেন, সেটা হলো মানবধর্ম। তিনি কোনো ঐশ্বরিক শক্তির উপাসনা করেননি, করেছেন শুধু মানবতাবাদকে। আধুনিক সাম্যবাদী সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যেন তাঁর সেই মানবধর্ম থেকেই উতসারিত। এ নীতিধর্ম অনুশীলন করে মানুষ নিজেকে সমুন্নত করতে পারে। বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষু সংঘকে লক্ষ্য করে বলেছেন-চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজনহিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায় অত্তায় হিতায় সুখায় দেবমনুস্ সানং। অর্থাৎ হে ভিক্ষুগণ! বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, দেবতা ও মানুষের কল্যাণের জন্য তেমরা দিকে দিকে বিচরণ করো। তোমরা সদ্ধর্ম প্রচার করো, যার আদিতে কল্যণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ,যা অর্থযুক্ত, ব্যঞ্জনযুক্ত ও পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রচার করো।
বর্তমান হিংসা বিক্ষুদ্ধ পৃথিবীতে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, জাতিতে জাতিতে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, যুদ্ধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর থেকে মুক্তি পথ আমদের খুঁজতে হবে।  বুদ্ধ বলেছেন-নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তীধ কুদাচনং,/ অবেরেন চ সম্মন্তি এস ধম্মো সনন্তনো।
এর অর্থ হলো,বৈরীতার দ্বারা বৈরীতা, শত্রুতার দ্বারা শত্রুতা কখনো প্রশমিত হয় না, অবৈরীতা ও মৈত্রী দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়। হিংসাকে হিংসার দ্বারা জয় করা যায় না, অহিংসা  দিয়েই হিংসাকে জয় করতে হয়; আগুনকে আগুন দ্বারা যেমন নেভানো সশ্ভব নয়, তদ্রুপ অসাধুতাকে সাধুতার প্রভাবে জয় করাই চিরন্তন সত্যধর্ম।
আজকের এই শুভদিনে আন্তরিক আহ্বান জানাব, সব মানুযের অন্তরে জাগ্রত হোক অহিংসা, সাম্য,মৈত্রী, করুনা দয়া ও প্রেম।
শান্ত হে মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য,/ করুণাঘন ধরণীতল. কর কলঙ্ক শূন্য।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, নিজ নিজ সম্পত্তি হতে বঞ্চিত না হোক।

সূত্র : মহাথেরো, বুদ্ধানন্দ। বৌদ্ধধর্ম বিশ্বমৈত্রীর ধর্ম । দৈনিক প্রথমআলো, ১৯মে, ২০০৮খ্রী:, পৃষ্ঠা-৮

বিষয় গ্রন্থপঞ্জি : মেডিটেশন (Meditation)

ধ্যান বিষয়ক কোন বইয়ের তথ্য থাকলে অনুগ্রহ পূর্বক জ্ঞাপন করুন
  • মহাথেরো, প্রজ্ঞাবংশ।বুদ্ধের ধ্যান পদ্ধতি। চট্টগ্রাম : প্রজ্ঞাবংশ একাডেমী, ১৯জুলাই২০০৮খ্রী:
  • মহাস্থবির, বংশদীপ। প্রজ্ঞা-ভাবনা। তাইওয়ান : দি কর্পোরেট বডি অব দ্য বুদ্ধ এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন, ১৯৯৫খী:
  • বড়ুয়া, জিতেন্দ্রলাল। মনুষ্যত্ব বিকাশে ধ্যান। ঢাকা : বিজয় লক্ষী বড়ুয়া, ২০০৫খ্রী:
  • শ্রামণ, বোধিপাল।সম্পাদিত। আর্যশ্রাবিকা রানুপ্রভার মহৎ জীবনী। চট্টগ্রাম : বোধিপাল বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র,২০০০সাল
  • সরকার, রমনী মোহন। অনুবাদ্। সম্যক স্মৃতি-চর্চা ও বিদর্শন ভাবনা। বোধগয়া : আন্তর্জাতিক ধ্যানকেন্দ্র, ২০০১খ্রী:
  • স্থবির, ধর্মতিলক।অনুদিত। কায়বিজ্ঞান। রাঙ্গামাটী : রাজবন বিহার,২০০১খ্রী:
  • Bhikkhu, pannawansa.edited. bishuddhi marga o bouddhasadana.Taiwan : The corporate body of the Buddha Educational Foundation,1936.
  • স্থবির, ধর্মদীপ্তি। সঙ্কলিত। বুদ্ধের জীবন ও বাণী। চট্টগ্রাম : বিশ্বশান্তি প্যাগোডা, ১৩৯৯বাংলা।পৃ-১১৩-১৪৯
  • মহাথের, সত্যপ্রিয়। সঙ্কলিত। অভিধর্মার্থ সংগ্রহ স্বরূপ দীপনী।চট্টগ্রাম : জ্ঞানালংকার ভিক্ষু , ১৯৯৪খ্রী:।পৃ : ১৭১-১৮৪
  • মহাথেরো, প্রজ্ঞাবংশ।অনুবাদ। সম্যকদৃষ্টি সূত্র ও অর্থকথা। খাগড়াছড়ি :উপাসক-উপাসিক পরিষদ,২০০৭।