বৌদ্ধ দর্শন

গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম। অনেকেই  তাঁকে প্রচলিত অর্থে দার্শনিক বলতে নারাজ। কারণ তিনি দার্শনিক আলোচনা থেকে শুধু বিরতই থাকেননি, বরং সেগুলোকে অহেতুক এবং সময়ের অপচয়  বলে মনে করতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে না তা নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। কিন্তু এটাই যে একটা বড় দর্শন, বর্তমান শতাব্দীর যেক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের (logical positivist) তত্তবিদ্যাবিরোধী বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
গৌতম বুদ্ধের চারটি আর্য সত্যের(চতুরার্য সত্য) সব কটিই দু:খকে কেন্দ্র করে। তাঁর শিক্ষা ও দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে কীভাবে দু:খের হাত থেকে বাঁচানো যায়। গৌতম বুদ্ধ দু:খের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাননি, তিনি দু:খকে জয় করতে চেয়েছেন। দু:খের হাত থেকে বাঁচার জন্য গৌতম বুদ্ধ কারও কাছে সাহায্য না চেয়ে নিজের ইচ্ছাশক্তি ও সংযমের মাধ্যমে দু:খের হাত থেকে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করেছেন। জগতে দু:খের কথা শুধু গৌতম বুদ্ধ একাই বলেননি, বিভিন্ন উপনিষদে দু:খ সম্পর্কে অনেক আলোচনা আছে। সাংখ্য দর্শনের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ সাংখ্যকারিকার প্রথম সূত্রই ত্রিবিদ দু:খ নিয়ে শুরু করেছে। ভারতীয় দর্শনের  একমাত্র চার্বাক সম্প্রদায় ছাড়া আস্তিক ও নাস্তিক সব কটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই দু:খ নিয়ে আলোচনা করেছে এবং এর হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করাকেই জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য বলে মনে করেছে। তবে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের কোন দার্শনিকই গৌতম বুদ্ধের মত এত গভীরভাবে এবং যোক্তিকতার সঙ্গে দু:খ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেননি।
গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার সঠিক মূল্যায়নের জন্য পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে শোপেন হাওয়ার (Schopen Hauer), নিটশে (Nietzsche), কিয়ের্কেগার্ড (Kierkegaard) প্রমুখ সম্পর্কে কী বলেছেন তার সঙ্গে তুলনা করে দেখতে পারি।
শোপেন হাওয়ার একজন দু:খবাদী দার্শনিক। তাঁকে অনেকেই‍‍‍ “Prince of Pessimism” বলেন। তাঁর মতে, এ জগত দু:খের আলয়। দু:খই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। সুখ অকল্পনীয় ও অসম্ভব বস্তু। যতই আমাদের জ্ঞান বাড়ে, ততই আমাদের দু:খ বাড়ে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ দু:খের কথা বললেও আশার বাণী শুনিয়েছেন, বাঁচার পথ দেখিয়েছেন। শোপেন হাওয়ার বৌদ্ধধর্মকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করলেও বুদ্ধের মূল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে আছেন। বুদ্ধের শিক্ষা আমাদের আশার আলো দেখায়, আর শোপেন হাওয়ার তাঁর সামনে পর্দা টেনে আমাদের হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দেন।
শোপেন হাওয়ার জ্ঞানকে সুখের অন্তরায় হিসেবে দেখেছেন। অথচ সব দর্শন ও ধর্ম জ্ঞানকে মুক্তির একমাত্র উপায় বা অন্যতম উপায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। এমনকি মীমাংসা দর্শনে যেখানে যাগযজ্ঞ ও উপাসনার প্রাধান্য বা বৈঞ্চব দর্শনে যেখানে ভক্তিতেই মুক্তির কথা বলা হয়েছে, সেখানেও জ্ঞানকে উপেক্ষা করা হয়নি। বরং জ্ঞানই যে মুক্তির মূলে তা স্বীকার করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মেও জ্ঞানকে মুক্তির পথ হিসেবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তাই গৌতম বুদ্ধের সম্যক জ্ঞানের উপর জোর দেওয়া যে কতটুকু সংগত তা সহজেই অনুমেয়।
নিটশেও দু:খ নিয়ে আলোচনা করেছেন । তবে তাঁর বক্তব্য আরও ভিন্নতর। তিনি প্রথম জীবনে শোপেন হাওয়ার দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরে সে প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। সে যাই হোক তিনি মায়া-মমতা, দয়া-সহানুভূতি ইত্যাদিকে অনেক ছোট করে দেখিয়েছেন। তাঁর কাছে মানবিক গুণের চেয়ে শক্তির গুরুত্ব বেশী। তিনি বলেন, উচ্চতর সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিম্নতর সম্প্রদায়ের ধ্বংস হওয়া উচিত। গৌতম বুদ্ধের দর্শন ঠিক এর বিপরীত। তাঁর শিক্ষা ভালোবাসা আর দয়ার কথায় পূর্ণ। তাঁর কাছে ছোট-বড় কেউ নেই। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই শ্রেণী বিভাগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, জন্মগত কারণে মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। তাই নিটশের দর্শনের মতো উচ্চতর শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিম্নতর শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের ধ্বংস বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনে অকল্পনীয়। কিয়ের্কেগার্ডও বুদ্ধের মত তত্ত্ববিদ্যায় উৎসাহী ছিলেন না এবং তাঁরও মূল লক্ষ্য মানুষের নৈতিক দিকটা। তিনিও বুদ্ধের মতো বলেছেন, কামনা-বাসনাই দু:খ আনে। তবে তাঁর এ ব্যাখ্যা ঈশ্বরকেন্দ্রিক, কিন্তু বুদ্ধের ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই। বুদ্ধের মতো কিয়ের্কেগার্ড বাসনার উর্দ্ধে যেতে চান না। কারণ তিনি মনে করেন, বাসনা ত্যাগ বৌদ্ধিক আত্মহত্যার শমিল। কামনা মূলত: দুই প্রকারের : স্বার্থপর কামনা এবং পরমার্থ কামনা। স্বার্থপর কামনাকে বাদ না দিলে কিয়ের্কেগার্ডের কাম্য মুক্তি (salvation) লাভ সম্ভব নয়। তাই তাঁর চেয়ে বুদ্ধের বত্তব্যই অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
আগই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যকটি দু:খের জন্য ব্যক্তি নিজেই দায়ী, অন্য কেউ নয়।আরব দেশের এক কবি বলেছিলেন, মারা যাওয়ার পর তাঁর কবরের ওপর যেন লিখে রাখা হয় যে, তাঁর পাপের জন্য তাঁর বাপ দায়ী। কারণ তাঁর বাপ না থাকলে তাঁর জন্ম হতো না এবং জন্ম না হলে তিনি পাপ করতেন না । কিন্তু বুদ্ধ কখনোই উদোরপিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাননি। তাঁর মতে, আমার দু:খ আমারই সৃষ্টি। শুধু দু:খ নয়, এমনকি আমাদের জন্মের জন্যও আমরাই দায়ী। জন্মলাভের বাসনা থেকেই আমাদের জন্ম হয়েছে।
প্রয়োগবাদ (Pragmatism) সম্প্রতিক কালের আর একটি দর্শন। এ দর্শনের মূল বক্তব্য হলো, যা কাজে লাগে এবং যা প্রয়োজনীয় ত-ই সত্য, তা-ই আলোচ্য ও বিবেচ্য হওয়া উচিত। সম্ভবত গৌতম বুদ্ধই প্রয়োগবাদেরও পুরোধা। মালুক্য পুত্রের তত্ত্ববিদ্যা বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে তিনি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, কেউ যদি তীর বিদ্ধ হয় তাহলে কী তার প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত? যেহেতু সে কষ্ট পাচ্ছে, সেহেতু সে প্রথমে তীরটা খুলবে। এর আগে সে নিশ্চয়ই ভাববে না, তীরটা কী গতিতে এল, তীরটা কে মারল, তীরটা কীসের তৈরী। তাই আমরা যেহেতু দু:খের সাগরে ভাসছি, আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত এই দু:খের হাত থেকে কিভাবে বাঁচা যায় তার চেষ্টা করা। বুদ্ধের মতে, আমাদের কাছে এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই।
সমকালীন দর্শনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ (Logical positivism) । এ মত অনুসারে principle of verification বা পরখনীতি হচ্ছে সত্যের মানদন্ড। যে বাক্যকে পরখ করা যায় না তা অর্থহীন। তাঁদের মতে, তত্ত্ববিদ্যাবিষয়ক অবধারণ এই পরখনীতির আওতায় পড়ে না। তাই এরা অর্থহীন। গৌতম বুদ্ধ পরখনীতির উল্লেখ না করলেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তত্ত্ববিদ্যায় আলোচ্য বক্তব্য প্রমাণও করা যায় না আবার অপ্রমাণও করা যায় না। গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রকার চরম মত ও পথের বিরোধী ছিলেন। সম্ভবত এটা তাঁর ব্যক্তি জীবনেরই অভিজ্ঞতার ফল। তিনি মধ্যমা প্রতিপদ বা মধ্যম পথকেই উত্তম পথ বলে স্বীকার করেছেন। অ্যারিস্টটল যে Golden Mean এর কথা বলেছেন তা তাঁর ২০০বছর আগে গৌতম বুদ্ধই বলে গেছেন। বস্তুত বুদ্ধের মধ্যমা প্রতিপদ ও অ্যারিস্টটলের Golden Mean এর মধ্যে পার্থক্য নিরূপন করা কঠিন।
অনেক পন্ডিত ব্যক্তি বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের আর একটি শাখা বলে মনে করেন। কেউ আবার মনে করেন, বৌদ্ধধর্মের মধ্যেই হিন্দুধর্ম পূণর্তা লাভ করেছে। যেমন, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো বক্তৃতায় বলেছেন, ‍’ Buddhism is the fulfillment of Hinduism. অনেকে আবার বৌদ্ধধর্মের সাথে খ্রীষ্ট ধর্মের মিল খুজেঁ পেয়ে এদের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্বন্ধ আছে কিনা তা খুঁজতে চান। ড. বেণী মাধব বড়ুয়া বলেন, ইহা নিশ্চিত যে, শুধু বাইবেলের পূরাকল্পে বর্ণিত প্রফেটগণের জীবন ও বাণীর ঐতিহাসিক ধারা দ্বারা যীশুখ্রীষ্টের জীবন ও বাণী ব্যাখ্যাত হয় না। ঐ ধারার সহিত অপর এক ধারার মণিকাঞ্চন সহযোগ আবশ্যক। অপর ধারা খুঁজিতে গেলে বাধ্য হইয়া ভারতের আর্য সংষ্কৃতির বৌদ্ধ ধারায় আশ্রয় লইতে হয়। বুদ্ধ ব্যবহৃত উপমাগুলি এবং যিশু খ্রীষ্টের প্যারাবেলস এর মধ্যে সাদৃশ্য এত ঘনিষ্ঠ যে, তাহা শুধু chance coincidence বলে যেন সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। যেমন বুদ্ধের উপমাগুলি ভারতের পূর্ববর্তী সাহিত্যে পাওয়া যায় না তেমন যীশুর প্যারাবেলস বাইবেলের পূরাভাগে পাওয়া যায় না। ড. বেণীমাধব বড়ুয়ার সংঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হয়েও অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায়, গৌতম বুদ্ধ ও যীশু খ্রিষ্টের শিক্ষার মিল আমাদের চিন্তাকে নাড়া না দিয়ে পারে না। আমার জানা মতে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোন মনীষীর আবির্ভাব ঘটেনি যিনি গৌতম বুদ্ধের মতো একাধারে নৈতিক শিক্ষার প্রবক্তা ও সমাজ সংষ্কারক এবং যার দর্শনকে অস্তিত্ববাদ, প্রয়োগবাদ ও যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সব ধর্মের শিক্ষিত প্রবক্তাদের কাছে তিনি সমাদৃত এবং এ বিষয়ে তিনি সত্যিই অনন্য। রাজত্বের লোভ ত্যাগ করে তিনি সত্যের সন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন। আজ তাই কোটি কোটি মানুষের হৃদয়সিংহাসনে তিনি সমাসীন।
সূত্র : ইসলাম, কাজী নূরুল। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন । দৈনিক প্রথমআলো, সোমবার, ১৯ মে ২০০৮খ্রী:, পৃষ্ঠা-৮ (প্রজ্ঞাদর্পন ব্লগ কর্তৃক পুন:র্মুদ্রিত)

৩টি মন্তব্য:

  1. Please share some Bengali translation of the Tripitaka books.

    উত্তরমুছুন
  2. Tank you for feedback. I will add a tab that describe a list of essential books written in bangla.

    উত্তরমুছুন
  3. I also want those. I have not found the Bengali translation of the following Books :
    1. Parivara Patho
    2. Niddesa
    3. Patisambhidamagga
    4. Apadana
    5. Cariyapitaka
    6. Nettippakarana
    7. Petakopadesa
    8. Kathavatthu
    9. Yamaka
    etc.

    Can you share the scanned copies of those books?

    Thanks

    উত্তরমুছুন