বিদর্শন ভাবনা

সম্যক স্মৃতি-চর্চা
অগগ মহাপন্ডিত উঃ সোভন মহাথের (মহাসি সয়াডো)

অনুবাদকঃ- শ্রীরমণী মোহন সরকার

প্রকাশকঃ
শিলিগুড়ি বুদ্ধভারতীয় আচার্য
শ্রীম বিনয় পাল ভিক্ষু
আন্তর্জাতিক ধ্যানকেন্দ্র
বোধগয়া, গয়া।

পুনঃ প্রকাশকঃ
দিলীপ বড়ুয়া, শিপ্রা বড়ুয়া, সুদীপ বড়ুয়া, প্রদীপ বড়ুয়া।


মুদ্রকঃ প্রজ্ঞাদর্পন ব্লগ কর্তৃক পুনঃমুদ্রিত।

পরম আর্য্যপুরুষ বনভান্তের আর্শীবাণী
নিজের মন-চিত্তের গতি সম্পর্কে অবিরাম সজাগ-সম্প্রজ্ঞানতা অবলম্বনের নাম বিদর্শন। সেই সম্প্রজ্ঞানত অনুশীলনকালে নিজের চক্ষু-কর্ণাদি ষড় ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাহ্যিক যে সকল বিষয় চিত্ত গ্রহণ করার পর মনে উদয় হয়, তা ক্ষণিকের মধ্যেই অস্থির চঞ্চল ভাব প্রাপ্তির মাধ্যমে অনিত্য ধর্মতা, দুঃখ ধর্মতার শিকার হয়ে থাকে। তা যদি আমি বা আমার নামক কোন ব্যক্তি, সত্ত্ব বা জীব হয়ে থাকতো তবে তো এমনটি হতে পারতো না। কারণ এজগতে যা কিছু প্রিয়-মনোপুত তা তো আমি চিরদিন একইভাবে পেতে চাই, উপভোগ করতে চাই। এই চির পাওয়া আর উপভোগকে-ই তো আমি সুখ শান্তি বলে বিশ্বাস করি। অতএব,দর্শন, শ্রবণাদি যা কিছু অনিত্যতা হেতু দুঃখ সৃষ্টিকারী ত সমুদয় আমি বা আমার নামক ধারণা বিশ্বাসের ইচ্ছাধীন নহে বিধায় আমার বলে দাবী করারো কোন যৌক্তিকতা নেই। ইহাই অনাত্মার উপলদ্ধি।
এভাবে প্রতিটি চিত্ত উপত্তিকে, ইহা আমি নই, আমার নহে, এবং আমার আত্মাও নহে;  সবই অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম-নিঃসত্ত্ব,নির্জীব; শুন্য; ধাতু সমষ্টিমাত্র। এভাবে নাম-রূপ পঞ্চস্কন্ধ জ্ঞানে যাবতীয় কর্ম সম্পাদনই বিদর্শন।
উপাসক দিলীপ বড়ুয়া এ জাতীয় আদর্শ গ্রন্থের পুনঃমুদ্রণ করে আর্শীবাদ প্রাপ্তির যোগ্য হলো।

আর্শীবাদক,

সাধনানন্দ মহাথেরো (বনভান্তে)।


ভূমিকা
মানুষ যখন বিষয়-ভাবনায় মশগুল হয়ে সংসার খেলায় মেতে থাকে, তখন সে আত্মবিস্মৃত সুষুপ্তিমগ্ন। এরকম চৈতন্যহীন প্রমত্ত ব্যক্তি আলোকের পথ খুজেঁ পায় না। তার জীবনের যাত্রা পথ হয়ে উঠে অন্ধকারাচ্ছন্ন। জীবন  তো অর্থহীন প্রলাপ নয়। জীবনের মর্মমূলে যে গভীর সত্য নিহিত আছে, তার উপলদ্ধিতেই জীবন হয় সার্থক সফল অন্যথা নয়। এভাবে জীবনকে সার্থকতায় ভরে তোলার জন্য আত্মবিস্মৃতি পরিহার জেগে উঠতে হবে। এ জাগরণই সম্যক স্মৃতি। সাধনপন্থারূপে এর অনুশীলনকে বলা হয় সম্যক স্মৃতি চর্চা।এক কথায় বলতে গেলে দেহ, মন, অনুভূতি ও মানসিক বৃত্তিসমূহের ওপর স্মৃতি নিরন্তর নিবদ্ধ রেখে সদা জাগ্রত থাকায় সম্যক স্মৃতি চর্চা। ব্রহ্মদেশের সুপ্রসিদ্ধ মহাযোগী উঃ সোভন মহাথেরো(মহাসি সয়াডো) আপনার সাধনালদ্ধ অভিজ্ঞতার আলোকেএ বিষয়টি সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন এ নিবন্ধে।
গভীর জীবন-জিজ্ঞাসা উঃ সোভনকে তরুণ বয়সে উম্মনা করে তোলে। তিনি সুখ আরাম বিসর্জন দিয়ে নির্জনচারী সাধকরূপে অশেষ ক্লেশ বরণ করেন। কখনো শ্মশানে কখনো বনে কখনো গিরি-গুহায় তাঁর দীর্ঘ সাধনাকালে অতিবাহিত হয়। অবশেষে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে দূর পল্লী অঞ্চলে মহাসি নামক একটি ক্ষুদ্র বিহারে তিনি অবস্থান করতে থাকেন। সেখানে বহু সন্ধানী সাধনেচ্ছু তাঁর নিকট সাধন পদ্ধতি সম্বন্ধে পাঠ গ্রহণ করেন।ফুল ফুটলে যেমন তার সৌরভ আপনি ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি তাঁর গুণমহিমা ক্রমে প্রচারিত হতে থাকে।
ব্রহ্মায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী উঃনু কৌতুহলী হয়ে অজ্ঞাত বেশে সে দূর পল্লীতে মহাসির নিভৃত নীড়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং প্রথম দর্শনেই অভিভূত হন। উঃনু মহোদয়ের সনির্বন্ধ অনুরোধে জনহিতায় তিনি রেঙ্গুনে আগমন করেন। সেই তেকে তিনি মহাসি সায়াডো নামে সর্বত্র পরিচিত হন। রেঙ্গুনের উপকন্ঠে এক মনোরম পরিবেশে তঁাকে কেন্দ্র করে প্রসিদ্ধ সাধন পীঠ য়েইকৃত গড়ে উঠে। এখানে শুধু ব্রহ্মদেশের নয়, প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাধনার্থীরা সাধন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এমনকি ইউরোপ আমেরিকারও বহু সন্ধানী তঁার চরণাশ্রয়ে সাধন প্রণালী সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করে থাকেন। এ সাধন পীঠ তাঁর অমর কীর্তি।

মহাসি সায়াডো এখন বৌদ্ধ জগতে একটি অবিস্মরণীয় নাম। রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ষষ্ঠ সংগীতির তিনি অন্যতম মূলস্তম্ভ। সতিপট্ঠান সূত্রের সারগর্ভ উজ্জল ব্যাখ্যারূপে তাঁর রচিত সুবৃহ  গ্রন্থ ব্রহ্ম সাহিত্যের একটি অনবদ্য অবদান। এ ছাড়া তিনি ব্রহ্ম ভাষায় আধ্যাত্ম বিষয়ক বহু পুস্তক প্রণয়ন করেছেন। আলোচ্য নিবন্ধখানি সম্যক স্মৃতি সম্বন্ধে ব্রহ্মভাষায় প্রদত্ত তাঁর উপদেশের সংগ্রহ মাত্র।

১৯৫১ সালে ২৭শে জুলাই য়েইকত নামে উক্ত ধ্যানকেন্দ্রে সাধনার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি যে ভাষণ দান করেন; তা টেপ রেকর্ড করা হয়। সেই থেকে তা বিভিন্ন ধ্যান কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের শুনানো হত। তঁাদের আগ্রহাতিশয্যে ১৯৫৪ সালে ইহা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। তিন বসরের মধ্যে এর ছয়টি সংষ্করণ নিঃশেষিত হয়ে যায়। বিদেশী সাধনার্থীদের সুবিধার্থে ১৯৫৭ সালে এর ইংরেজী সংষ্করণ বের হয়।এখন ইহা সিংহলী, থাই প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত। মহাসি সয়াডের অন্যতম শিষ্য বিদর্শনাচার্য অনাগরিক মুনীন্দ্রজীর ঐকান্তিক চেষ্টায় এবার এর বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হওয়ায় বাঙ্গালী বিদর্শন সাধনার্থীদের প্রভূত উপকার সাধিত হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর শুভ প্রচেষ্টা প্রশংসার্হ।

বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ করেছেন শ্রী রমনী মোহণ সরকার মহাশয়। তিনি নিজে একজন সাহিত্যরসিক কৃতবিদ্য ব্যক্তি। গূঢ় সাধনতত্ত্ববিষয়ক অনুবাদ সহজ সাধ্য নয়। কিন্তু সরকার মহাশয়ের নিপুণ লেখনীতে মূলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদর্শন সাধনার গভীর তত্ত্ব সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর অনুবাদের ভাষা সরস ও প্রাঞ্জল। সংশ্লিষ্ট মহলে এ বইখানি অপরিহার্য্য।
ইতি
শীরনন্দ ব্রহ্মচারী
সংগীতি
মধ্যমগ্রাম, ২৪ পরগণা।
ফাল্গুনী পূর্ণীমা, ১৩৭৮।


বিদর্শন ভাবনা ও সম্যক স্মৃতি চর্চা গ্রন্থ পর্যালোচনা
বর্তমান পুস্তক আকারে প্রকাশিত এবং বিশ্বের নানা ভাষায় বহু প্রচারিত এই গ্রন্থদ্বয় মূলতঃ দুইটি ভাষণ। মায়ানমার রাষ্ট্রের দুই প্রখ্যাত সাধক, বৌদ্ধ বিশ্বে যাদের নাম অতীব শ্রদ্ধা ও গর্বের সাথে উচ্চারিত সেই তংপুলৃ কাবায়ে সায়াডো (উ ঞাণিন্দা জন্ম ১৮৯৭খ্রীঃ) মহোদয়ের ভাষণ বিদর্শন ভাবনা নামে ডাঃ কল্যাণমিত্র বড়ুয়া কর্তৃক অতি দক্ষতা ও প্রাঞ্জলভাবে বাংলা ভাষায় প্রথম অনুবাদিত হয় এবং ১৯৭৯ খ্রীঃ কলিকাতাস্থ বিদর্শন শিক্ষা কেন্দ্রের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। অগ্রমহাপন্ডিত সাধকাচার্য ভদন্ত মহাসী সায়ডো (উ সোভনা, জন্ম ১৯০৪ খ্রীঃ মহাপ্রয়াণ ১৯৮২খ্রীঃ) প্রদত্ত ভাষণ সম্যক স্মৃতি চর্চা নামে রমনী মোহন সরকার কর্তৃক অনুবাদিত হয়ে ১৯৭১ খ্রীঃ বুদ্ধগয়া আন্তর্জাতিক ধ্যান কেন্দ্রের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়।
বৌদ্ধ ধ্যান সাধনা অনুশীলনের মাধ্যমে জাগতিক দুঃখ-যন্ত্রণা হতে অব্যাহতি প্রত্যাশীগণের জন্য মার্গজ্ঞানে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালাভী এ দুই মহাসাধকের স্ব অভিজ্ঞা প্রসূত ভাষণদ্বয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ পথ প্রদর্শক রূপে একান্তই নিরাপদ আশ্রয় বলে আমার বিশ্বাস।
ডাঃ কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া এবং রমনী মোহন সরকার  মহোদয়গণ ভাষণদ্বয় বাংলায় অনুবাদ করে দিয়ে এবং ভারতের প্রতিষ্ঠান দ্বয়ের কর্তৃপক্ষ তা পুস্তকাকারে প্রকাশ করে বৌদ্ধ সাধক-সাধিকা সহ বৌদ্ধ ধ্যান সাধনা অনুসন্ধিসুদের নিকট চির কৃতজ্ঞতা ভাজন হলেন। কিন্তু, এ মূল্যবান গ্রন্থদ্বয় বাংলা ভাষাভাষী সাধক-সাধিকাগণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বহু পূর্বেই নিঃশেষ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পশ্চিম গহিরা নিবাসী সাধক এবং ত্রিরত্নে অনাবিল শ্রদ্ধাবান উপাসক দিলীপ বড়ুয়া(দীপু) এই মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য পুস্তিকাদ্বয়কে যুগ্ম সংগ্রহ রূপে পুনঃ মুদ্রণের উদ্যোগ নিয়ে বাংলা ভাষী সাধক-সাধিকাদের অশেষ উপকার সাধন করলেন। আমরা তাঁর এই বিজ্ঞোচিত উদ্যোগকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। তিনি এই পরমার্থিক গ্রন্থদ্বয় মুদ্রণে আর্থিক ত্যাগের বিনিময়ে বুদ্ধ কর্তৃক প্রশংসিত ধম্মদানং সব্বদানং জিনাতি এই মহাবাক্যের সম্যক অনুশীলন করলেন। আমরা তাঁর এবং সকল প্রিয় জ্ঞাতীগণের নির্বাণ শান্তি কামনা করি।
এখন পুস্তিকাদ্বয়ের উপর কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন মনেকরি। বৌদ্ধ সাধক সাধিকাগণের সমাবেশে  প্রদত্ত ভাষণই বর্তমান পুস্তিকাদ্বয়ের জন্ম-উস। মহাসাধস তংপুলু কাবায়ে সয়াডো কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের বাংলা অনুবাদেও সেই বৈঠকি সংলাপেরও মেজাজ অত্যন্ত প্রাণবন্ত ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ভগবান তথাগত বুদ্ধও ধর্মদেশনা কালে সবসময় এই প্রশ্নোত্তর রীতি অনুসরণ করতেন। প্রতিপাদ্য বিদর্শন ভাবনা পুস্তিকায় এই রীতির অনুশীলন ভদন্ত তংপুলু কাবায়ে সয়াডো কর্তৃক কিভাবে অনুসৃতঃ হয়েছে নিম্নে প্রদত্ত উদৃতি থেকে সহজে অনুধাবন করা যাবে-তাহলে জানতে পরলে বিদ্য, না জানতে পারলে কি? ভন্তে! জানতে না পারলে অবিদ্যা। হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ। কারণ অবিজ্জা বুচ্চতি অঞ্ঞানংক অর্থা অবিদ্যা হচ্ছে অজ্ঞান, না জানা। অতএব, তোমার উত্তর ঠিক হয়েছে। অিবদ্যা, মোহ, না জানা-সব একই অর্থবাচক। বিদ্যা, অমোহ এবং জানা- এগুলোও একই অর্থবোধক শব্দ।
এভাবে সংক্ষিপ্ত সংলাপ ভঙ্গিতে এবং অসংখ্য পিটকীয় উপমা, উদ্বৃতিকে যথাস্থানে সুদক্ষ কারিগরের ন্যায় ভদন্ত মহোদয় স্বঅভিজ্ঞতায় সংযোজন করেছেন এই নাতিদীর্ঘ ভাষণে। এই বক্তব্যে যদি সাধক না হয়ে শুধুমাত্র ত্রিপিটক ধর কর্তৃক তা প্রদত্ত হতো তাহলে মনে হতো তিনি কোন ক্লাশের ছাত্রদের পাঠদান করছেন।  কিন্তু, তংপুলু কাবায়ে সয়াডো মহোদয়ের সাধন অভিজ্ঞতার পূর্ণতায় প্রতিটি কথায় যেন সমগ্র ত্রিপিটক মন্থন করে অমৃতরাশি ঝরে পড়েছে এখানে। জাগতিক ব্যস্ত জটিল জীবনে বস্তুর চাকচিক্য মোহে নিমজ্জিত মানুষের কাছে এ সকল পারমার্থিক বিষয় কিছুতেই সুস্বাদু খাদ্য নহে। কিন্তু, অনুবাদের সাফল্যে এই ক্ষুদ্র পুস্তিকা পাঠ করলে পরমার্থিক চুম্বকীয় আকর্ষণের প্রবল স্রোত যেন এক নিশ্বাসে সমাপ্তির দোর গোড়ায় নিয়ে দাঁড় করায় প্রতিটি বাক্যে নির্বাণ অমৃত আস্বাদনের মাধ্যমে। ভদন্ত তংপুলু কাবায়ে সয়াডো মহোদয়ের অনির্বচনীয় বাক্য মাধুর্যে তখন পরিতৃপ্তি এবং আয়ত্বের উসাহে এবং অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়ে যায় বুদ্ধ কন্ঠের এই আশ্বাস বাক্যে-
যো চ বসস সতং জীবে অপসসং উদয়ব্বয়ং,
একাহং জীবতিং সেয়্যা পসসতং উদয়ব্বয়ং
অর্থা স্মৃতিহীন হীনবীর্য হয়ে একশত বসর বেঁচে থাকার চেয়ে স্মৃতিমান বীর্যবন্ত পুরুষ কর্তৃক নাম-রুপের উদয়-ব্যয় দর্শন করে মুহুর্ত কাল বেচেঁ থাকাই শ্রেয়।
অতএব, তোমরা এই যে বসে আছ, এই মুহুর্তে মাত্র এক মিনিট কাল বসে আছি বসে আছি বলে বলে জ্ঞাত হতে পারলে অতীতের ফেলে আসা জীবনের সমগ্র  সময় গুলোর চেয়ে উত্তম হবে নহে কি?
সাধু! সাধু! সাধু! আমরাও আন্তরিক সাধুবাদ দিয়ে এই মহান আর্য পুদ্গলের সদ্ধর্ম ভাষণকে সকৃতজ্ঞ অভিনন্দিত করছি। তবে এ পুস্তিকার ১৩ পৃষ্ঠায় ভদন্ত মহোদয় কর্তৃক পিটকীয় উদ্ধৃতি- দানসীলুপনিসসয়া হি তয়ো মগগো চ ফলানি চ পাপেতি। ভাবনুপনিসসয়ো অরহত্তং পাপেতি
অর্থা দানশীলকে ভিত্তি করে ত্রিবিধ মার্গফল স্রোতাপন্ন, সকৃদাগামী, অনাগামী, পর্যন্ত লাভ করা যায়। আর ভগবানকে ভিত্তি করেই অরহত্ত লাভ হয়। এই বাক্যটি আমার বহুদিনের ভুল ধারণার অবসান ঘটালো। আমার ধারণা ছিল ধ্যানের প্রথম স্তরে চিত্ত উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত মার্গচিত্ত-ফলচিত্ত উপন্ন হয় না। মহাসাধক তংপুলু কাবায়ে সয়াডো মহোদয়ের উপরোক্ত পিটকীয় বক্তব্য নিয়ে পরম শ্রদ্ধেয় বনভান্তের সাথেও আলোচনা। তিনি সয়াডো মহোদয়ের সাথে অভিন্ন মত পোষণ করেন।
মহান সাধন, বিশাল মেধাশক্তি ও শাসনিক প্রতিভার অধিকারী সমগ্র ত্রিপিটক কন্ঠস্থকারী অগ্রমহাপন্ডিত মহাসী সয়াডো মহোদয়ের ১৯৫১ খ্রীষ্টব্দের ২৭ শে জুলাই, রেঙ্গুনস্থ তাঁর বিশ্বখ্যাত ধ্যান কেন্দ্রে সাধক-সাধিকাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ বর্তমানে সম্যক স্মৃতি চর্চা নামে শ্রী রমনী মোহন সরকার কর্তৃক বাংলায় অনুদিত হয়েছে। অনুবাদকের মধ্যে  ভাষাগত কিছু দুর্বলতা পরিলক্ষিত যেমন হয়েছে, তেমনি পুস্তকের বিষয়বস্তু বর্ণনায়ও সরস প্রাণবন্ত ভাব ধরা দেয়নি। তবুও ভদন্ত মহোদয়ের স্বলদ্ধ সাধনা অভিজ্ঞতার সাথে সাধনা অনুশীলনকারীদেরকে পরিচালনা অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে এই ভাষণটি একজন বৌদ্ধ সাধককে সম্যক নির্দেশনায় ব্যাপক ভাবে সহায়তা দানে সক্ষম। আমার কাছে এই পুস্তিকাটির যে সকল তথ্য আকর্ষণীয় বলে মনে হলো তা নিম্নে উদ্ধৃত করা গেল-
১১পৃঃ যারা প্রাকৃত বা সাধারণজন বিদর্শন ভাবনা সম্পর্কে অজ্ঞ কিংবা অনভিজ্ঞ, তাদের মত এই যে, দর্শন কার্যের কর্ত্তা তারাই। তারা বিশ্বাস করে, আমি দেখছি, আমি শুনছি-ইত্যাদি। এরুপ ধারণা বা বিশ্বাসকে পালিশাস্ত্রে সক্কায় দিটঠি (দেহাত্ম বোধ)বলা হয়েছে।
১৩পৃঃ এই সক্কায়দিটঠি থেকে বিমুক্ত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। কারণ, একমাত্র এই ভ্রান্ত দৃষ্টিই অপায়াদি নারকীয় জন্মান্তরের জন্য দায়ী। সক্কায়দিটঠিসম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ হয় একমাত্র আর্যমার্গ মার্গফলের দ্বারা- অর্থা  শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা এই ত্রয়ী নীতির অনুশীলনে। তাই এই নীতিগুলির উকর্ষ সাধনে তপর হতে হবে। কিন্ত কি ভাবে?
সক্কায় দিটঠিপ্পহানায় সতো ভিকখু পরিব্বজে, এখানে অবিরাম প্রত্যবেক্ষণ বা অনুধাবন এবং পরিব্বজে অর্থা সমস্ত কলুষ থেকে মুক্তি লাভ করে।
১৩ পৃঃ সম্যকভাবে জানার জন্য লক্ষ্য, নিরীক্ষণ বা চিন্তন অর্থে-দৃশ্য বস্তুর উপর মন স্থির করার কথাই বলা হয়েছে। এভাবে দৃ্শ্যবস্তুর উপর মন স্থির করার ফলে কখনো দৃশ্য বস্তুর লক্ষ্য করা হয়, কখনো এর মানসিক ক্রিয়া লক্ষ্য করলেই চলে, আবার কখনো বা দর্শনেন্দ্রিয় এই তিনটির যে কোন একটিতে লক্ষ্য করলেই চলবে। এর ব্যতিক্রমে সক্কায় দিটঠি বা দেহাত্মবোধ তথা আমি, আমার ধারণা এবং নিত্য, শুভ, সুখ বলে কল্পনায় আসক্তি ও আকাঙ্খা জাগিয়ে তুলবে। এ থেকেই আসে কর্মপ্রেরণা আর কর্মের অনুষ্ঠান যা পুনর্জন্মের পথেই নিয়ে যায়।
১৮পৃঃ দৈহিক চেতনা সব সময়েই বর্তমান থাকে। তাই সবসময় এই চেতনা সুষ্ঠুভাবে অনুভব করা সম্ভব। কোন ব্যক্তি যখন বসে থাকে তখন দৈহিক স্থানুত্ব বা কাঠিন্য বোধ স্বভাবই অনুভূত হবে। এমতাবস্থায় শারিরীক অবস্থানের প্রতি মনযোগ দেয়া এবং বসা, বসা, বসা এভাবে স্মৃতি অনুশীলন করা উচিত। ইহা নতুন যোগীদের জন্য সহজ উপায়।
২০ পৃঃ আরম্ভকারীদের পক্ষে আরো সহজতর এবং সরলতর পন্থা হবে, প্রতিবার শ্বাস-প্রশ্বাসে নাভিদেশের যেই উঠানামা হয় তা বিশেষ লক্ষ্য বা নিরীক্ষণ...। কারণ এগুলো অত্যন্ত স্থুল এবং স্পষ্ট।
২০পৃঃ [অনুশীলন কৌশল]
মন ও জড়বস্তুর মধ্যে মনের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সূক্ষ এবং অস্পষ্ট। কিন্তু জড় উপাদানের কার্যগুলি অধিকতর স্থুল ও স্পষ্ট। তাই বিদর্শন ভাবনা সাধারণ পদ্ধতি হিসেবে প্রথমেই এই স্থুল বিষয়ে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।
বসা অবস্থায় শারিরীক যে অবস্থা তার সামগ্রীক রূপ সম্বন্ধে মনযোগ দিলেই চলবে। যেমন- নিম্মাঙ্গ কিভাবে বেঁকে বৃত্তাকার রূপ নিয়েছে, উর্দ্ধাঙ্গ যে রূপ ঋজুভাবে অবস্থান করছে। অবশ্য এটা ঠিক যে বসা, বসা করে পুনঃ পুনঃ পর্যালোচনা করাতে একজনের ক্লান্তি বোধ স্বাভাবিক। সমাধির দুর্বলতা এবং প্রচেষ্টার অপ্রতুলতাই এর কারণ। তাই বীর্য এবং প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। আর এর জন্যে প্রয়োজন প্রচেষ্টর বিভিন্নতা ও পরিধির বিস্তার বসার পর্যালোচনার পর দেখতে হবে দেহের কোন অংশে স্পর্শানুভূতি কার্যকরী হচ্ছে এবং এভাবে স্পর্শে পর্যালোচনায় মনোনিবেশ করতে হবে। হাত, পা, জিহ্বা প্রভৃতি দেহের কোন অংশে স্পর্শানুভূতি প্রবল, এটা লক্ষ্য করলেই যথেষ্ট।
২১ পৃঃ শ্বাসক্রিয়ায় নাভি দেশের উত্থান পতন কোন কোন সময় স্পষ্ট না হলে দুই হাত নাভিমূলে রাখুন। কিন্তু কিছুতেই শ্বাসের স্বাভাবিকতা পরিবর্তন করা যাবে না। অর্থা ইচ্ছা করে জোরে জোরে শ্বাস নেয়া উচিত নহে। এতে সাধক অল্প সময়ে দুর্বল হয়ে পড়বেন।
উপসংহারে বলতে চাই, ইদানিং বাংলা ভারতে শুধু নহে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানসিক শান্তির অন্বেষণকারীদের হাতে থেরবাদ ও মহাযান বাদী বৌদ্ধ ধ্যান অনুশীলন উপযোগী বহু গ্রন্থ পৌছে গেছে। অধিকন্তু তাঁরা অনেক ধ্যান গুরুর সান্নিধ্য লাভেও ধন্য হচ্ছেন। এতে তাঁরা কিছু না কিছু উন্নতি যে না হচ্ছেন তা নহে। এ জাতীয় বহু সাধক-সাধিকার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। তাদেঁর সাথে ধ্যান সম্পর্কিত আলাপের মাধ্যমে যা জানতে পেরেছি এবং তাদেঁর কায়িক বাচনিক একান্ত ব্যবহারে যতটুকু উপলদ্ধি করতে পেরেছি তাতে আচার্যদের পুথিঁগত বিদ্যা এবং চিন্তাময় জ্ঞানের গন্ধই বেশী পেয়েছি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো ধ্যান-কেন্দ্র নামক প্রতিষ্ঠান এবং ধ্যান শিক্ষা শিবির নামক ১০/২০ দিনের কোর্স গুলোর অধিকাংশের গতনুগতিকতা ও বাণিজ্যিককরণ মানসিকতা বুদ্ধের নৈর্বাণিক দুঃখমুক্তির পন্থাকে একটি বড়ো প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। নানা মুণির নানা মতে ও পথে মহাবিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছে বুদ্ধের আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ ভাবনা। এই মহাদুর্যোগের হাত হতে পরিত্রাণ লাভে মহাসতিপট্ঠান সূত্রে বিধৃত প্রতিটি ভাবনা প্রণালীর সমন্বয় সাধন আজ একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই প্রয়াসে সকলের শুভ বুদ্ধি কামনা করছি।

ইতি
সস্বুদ্ধ শাসন হিতকামী
প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো
রাজবন বিহার, রাংঙ্গামাটি
২৫৪৫বুদ্ধাব্দ
১০/০৯/২০০১খ্রীঃ