বৌদ্ধ ধর্মান্তর প্রসঙ্গে -ভদন্ত এস. ধাম্মিকা


প্রশ্নঃ- আমি যদি বৌদ্ধ হতে চাই, তাহলে আমাকে কী করতে হবে?
উত্তরঃ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। বুদ্ধের সময়ে উপালী নামে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী একজন বিখ্যাত পন্ডিত যুক্তি তর্কে বুদ্ধকে পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে বুদ্ধের কাছে যান। বিভন্ন বিষয়ে আলোচনার পর তিনি বুদ্ধের দর্শন পর্যলোচনায় মুগ্ধ হয়ে নিজেই বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে বুদ্ধের অনুসারী হতে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা বুদ্ধকে জানালে বুদ্ধ উপালীকে বলেনঃ
যে কোন কাজ তাড়াহুড়া করে করা উচিত নয়। সব কাজ ধীরে ধীরে নির্ভূল ভাবে করা উচিত। প্রথমে সম্যকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করুন; তাড়াহুড়া না করে এই বিষয়ে আরও প্রশ্ন করার অবকাশ নিন। আপনার মতো একজন খ্যাতিমান পন্ডিতের জন্য এটি বিশেষ প্রয়োজন। যথার্থ বিচার বিশ্লেষণ না করে সিদ্ধান্ত নেয় সমীচিন নয়।
উপালী বলেছেন, “বুদ্ধ আমাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে ঐভাবে বলাতে  আমি বুদ্ধের প্রতি আরও মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে সারা নগরে প্রচার-পত্র বিলি করে বিখ্যাত পন্ডিত উপালীর ধর্মান্তরিত হবার খবর প্রচার করে নিজ ধর্মের মহিমা প্রকাশ করা যেত। কিন্তু বুদ্ধ তা না করে আমাকে তাঁর দেশিত ধর্ম অবলম্বনের আগে গভীরভাবে যুক্তি, বিচার, বিশ্লেষণের উপদেশ দিলেন” [মধ্যম নিকায়২য় খন্ড পৃঃ৩৭৯]
বৌদ্ধদর্শন বিচার  বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে কোন বিষয়কে বুঝার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যে কোন কাজ সময় নিয়ে, ধীরে-সুস্থে, তাড়াহুড়া না করে সম্পাদন করতে বুদ্ধ আনুসারীদের উপদেশ দিয়েছেন। বিপুল সংখ্যায় অনুসারী সৃষ্টি করতে তিনি কখনও আগ্রহী ছিলেন না। বরং যাঁরা তাঁর অনুসারী হচ্ছেন, তাঁরা বিচার বিশ্লেষন করে গ্রহণ করছেন কিনা, সেই ব্যপারে তিনি উদ্বিগ্ন থাকতেন।
প্রশ্নঃ- আমি নিজে এই বিষয়ে বিশ্লেষন করেছ; বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে এখন আমার কি করা প্রয়োজন?
উত্তরঃ এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ হলো- আপনি প্রথমে কোনও বৌদ্ধ বিহারে বা বৌদ্ধধর্মীয় কর্মী সংগঠনে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করুন ও বৌদ্ধ দর্শন, বৌদ্ধ জীবনাচার সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। তারপর যখন মনে হবে আপনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিরত্নের শরণ নিয়ে বৌদ্ধ হবেন।
প্রশ্নঃ- ত্রিশরণ কি?
উত্তরঃ শরণ হলো আশ্রয়স্থল  যেখানে বিপদগ্রস্থ মানুষ নিরাপত্তার আশ্রয় গ্রহণ করেন। আশ্রয়স্থল নানা প্রকারের- অসুখী হলে মানুষ আশ্রয় নেয় বন্ধুবান্ধবের। মৃত্যপথযাত্রী মানুষ আপন বিশ্বাস অনুযায়ী স্বর্গে আশ্রয় কামনা করেন। বুদ্ধের মতে ঐ ধরণের কোন আশ্রয়স্থল নয়। কারণ ঐ সব আশ্রয়স্থল প্রকৃত স্বস্তি ও শান্তির নিরাপত্তা দিতে পারে না।এই প্রসঙ্গে বুদ্ধের উক্তি-
“চতুরার্য সত্যে অর্থাৎ দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ রোধ এবং দুঃখ রোধের উপায়, আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের আশ্রয় গ্রহণ করলে মানুষ সকল প্রকার দুঃখ থেকে অব্যহতি পান। কার্যকারণ ভিত্তিক নয়, এইরূপ আশ্রয় স্থলে আশ্রয় নিতে আপাতদৃষ্টিতে নিরাপত্তা বোধ হয় বটে, সেই আশ্রয়স্থল প্রকৃতপক্ষে নিরাপদ আশ্রয় নয়। বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ এই তিন আশ্রয়স্থল সবোর্ত্তম আশ্রয়স্থল। কেননা, এটি মঙ্গলামঙ্গল কার্যকারণ প্রক্রিয়াজাত। বুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণের অর্থ, বুদ্ধের মতো অজ্ঞতার অন্ধকার মুক্ত হয়ে জ্ঞানালোকে আলোকিত হতে উদ্বুদ্ধ হবার আশ্রয়স্থলে গমনোদ্যোগ। ধর্মে আশ্রয় গ্রহণের অর্থ, প্রত্যক্ষভাবে পরীক্ষিত,সুব্যখ্যাত, সর্বকালীন, সার্বজনীন প্রকৃত সুখশান্তিপ্রদ বুদ্ধের দেশিত জীবনাচরণে উদ্বুদ্ধ হবার গমনোদ্যোগ। সংঘে আশ্রয় গ্রহণের অর্থহলো, যাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র এবং বুদ্ধ ও ধর্ম বিষয়ে সুপন্ডিত, সদাচারী, যাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র এবং বুদ্ধ ও ধর্মের ব্যাখ্যা সহজভাবে ও বোধগম্য করে প্রচার করেন, তাঁদের  উপদেশাদি ও জীবনাচারণে অনুশীলনোদ্যোগ গ্রহণ”। [ধম্মপদ পৃঃ১৮৯-১৯২]
প্রশ্নঃ- ত্রিরত্নের আশ্রয় গ্রহণের পর আপনার জীবনে কি কি পরিবর্তন এসেছে?
উত্তরঃ বুদ্ধের শিক্ষা ২৬০০ বছরে সময় ব্যাপী কোটি কোটি মানুষের মতো আমাকে জগত জীবনের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে জীবন জগতের নিত্য দুঃখ যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জীবনাচরণ অনুশীলন করে জীবনের দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছে। বুদ্ধ নির্দেশিত মানবিক, নৈতিক ও সংযত জীবন যাপন করলে জীবন কিরূপ পবিত্র ও আনন্দময় হয়ে উঠে, তা উপলদ্ধি করতে পেরেছি। আমি এতে প্রশান্ত ও শুদ্ধ জীবন যাপন করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে একজন কবি নিবেদন করেছেনঃ- তাঁর কাছে আশ্রয় নিতে যাওয়া, তাঁর প্রশংসাস্তুতি, তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং প্রচারিত ধর্মের অনুশীলন করার মাধ্যমে তাঁর বাণীকে সম্যকভাবে বুঝে নেবার সুযোগ ঘটে এবং এক অনাবিল প্রশান্তি ও আনন্দে জীবন ভরে ওঠে।
প্রশ্নঃ- আমার এক বন্ধু তাঁর ধর্মে আমাকে ধর্মান্তরিত করতে চান।কিন্তু আমি তাঁর ধর্ম গ্রহণ করতে আগ্রহী নই। এই অবস্থায় কি করা যায়?
উত্তরঃ প্রথমতঃ বুঝতে হবে ঐ ব্যক্তি আপনার প্রকৃত বন্ধু কিনা? একজন প্রকৃত বন্ধু আপনাকে আপনার মতো করে আপনার রুচি, বিশ্বাস, আচরণকে যথোচিত সম্মান করবেন। আমার মনে হচ্ছে, আপনার ঐ বন্ধু আপনার বন্ধু হবার ভান করে আপনাকে ধর্মান্তরিত করতে চাচ্ছেন। যাঁরা নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেন, তাঁরা প্রকৃত বন্ধু হতে পারেন না।
প্রশ্নঃ- তিনি আমাকে তাঁর ধর্মীয় অনুভূতির অংশীদার করতে চান। এখানে আপনার অভিমত কি?
উত্তরঃ নিজের মতের সঙ্গে বন্ধুকে অংশীদার করা ভালো। কিন্তু আপনার বন্ধু ধর্মানুভূতির অংশীদারী করা এবং চাপিয়ে দেয়ার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পাচ্ছেন বলে মনে হয় না। ব্যাপারটি অনেকটা এই রকমঃ মনে করুন, আমার একটি আপেল আছে। আমি এর অর্ধেক আপনাকে কেটে দিলাম, বাকীটা আমি খেলাম। এখানে ব্যাপারটি অংশীদারী। কিন্তু আমি যদি গোটা আপেলটিখেতে খেতে আপনাকে অর্ধেক আপেলের অংশীদার হতে বলি, তাহলে তা অংশীদারী করার প্রস্তাব হতে পারে না। অনেকে আপনার বন্ধুর মত ভান করে নিজের হীনস্বার্থ উদ্ধার করতে চেষ্টা করেন। এইরূপ ব্যক্তির কাছ থেকে সাবধান থাকা নিরাপদ।
প্রশ্নঃ- তাহলে কি করে আমার বন্ধুকে থামানো যায়?
উত্তরঃ কাজটি সহজ। আপনি কি করতে চান প্রথমে সিদ্ধান্ত নিন। তারপর আপনার বন্ধুকে স্পষ্টভাবে তা বলে দিন। এরপরেও যদি তিনি আপনাকে সঙ্গে নিতে চান, তখন বিনীতভাবে বলুন, আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ; কিন্তু আমি আপনার ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে চাই না।
কেন চান না?
সেটি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আমি বন্ধু হিসেবে আপনাকে আমার সঙ্গে নিতে চাই
আমার ব্যাপারে আপনার আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আপনার সঙ্গে যেতে আগ্রহী নই
উপরে সাজানো কথোপকথনের মহড়ার মতো বারবার ধৈর্য্যের সঙ্গে বিনীতভাবে আপনার অনিচ্ছার কথা বলতে থাকলে, অবশেষে তিনি ক্ষান্ত হবেন। বন্ধুর সঙ্গে ঐভাবে কথোপকথনের ব্যাপারটি বিব্রতকর বটে, কিন্তু ঐপরিস্থিতিকে ঐভাবে সামলানো ছাড়া উপায় নেই।
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধদের কি উচিত অন্য ধর্মবলম্বীদের তাঁদের সদ্ধর্মে অংশীদার করার চেষ্টা করা?
উত্তরঃ তা করতে কোনও বাধা নেই। কারণ কোনও মতবাদে অংশীদার করা এবং চাপিয়ে দেয়ার পার্থক্যটি বৌদ্ধেরা বুঝতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। কেউ বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলে, এমনকি জানতে না চাইলেও স্থান কাল পাত্র বিশেষে বিচার করে বুদ্ধের শিক্ষার কথা বলা যেতে পারে। তবে যদি লক্ষ্য করা যায়,শ্রোতা আপনার কথা শুনতে আগ্রহী নন্, বরং তিনি নিজ ধর্ম সম্পর্কে অতি উৎসাহী, সেক্ষেত্রে তাঁর ধর্মের প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করে আপনার অভিমত সম্বন্ধে বক্তব্য প্রদান করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্চনীয়। মনে রাখবেন, সদ্ধর্ম প্রচারণার জন্য ধর্মোপদেশের জন্য জীবনাচরণের মাধ্যমে সদ্ধর্মের প্রচার অধিকতর কার্যকরী। শুধু কথায় নয়, কায়-মনো-বাক্যের মাধ্যমে, সদ্ধর্মের অন্তর্নিহিত মৈত্রী-করুণা-ক্ষমা-সহনশীলতা-ত্যাগের কথা নিজের জীবনাচরনের মাধ্যমে চার পাশের মানুষের কাছে প্রচার করুন।
যদি আমরা সবাই বৌদ্ধ দর্শনের মর্মবাণী সম্যকভাবে বুঝতে পারি এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুশীলনে প্রয়াসী হই, ঔদার্যের  মনোভাব নিয়ে অন্যদের  অনুপ্রাণিত করি, তাহলে তা আমাদের এবং অন্যদের মহামঙ্গল সাধন করবে।
 [*** ঝড় তুফানের এলোপাথারী ঝাপ্টায় যেমন ভারী শিলাখন্ড অনড় থাকে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা তেমনি সংসারের নিন্দা-প্রশংসার অকম্পিত হৃদয়ে সংসারে বিচরণ করেন।***]


[***গভীর জলাকীর্ণ হ্রদ যেমন স্ফটিকের স্বচ্ছতায় প্রশান্ত হয়ে বিরাজমান থাকে, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি তেমনি সদ্ধর্ম জ্ঞাত হয়ে অপ্রমেয় শান্তিতে বসবাস করেন।***]


[***ক্রোধকে অক্রোধ এবং শত্রুতাকে মৈত্রী দিয়ে,


ঈর্ষাপরায়নতাকে ক্ষমা দিয়ে জয় করিবে।


যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ যোদ্ধাকে পরাজয় করা অপেক্ষা


যিনি নিজের লোভ, দ্বেষ, মোহাদি রিপুকে


মুদিতা ও উপেক্ষার দ্বারা জয় করেছেন,


তিনিই প্রকৃত বিজয়ী বীরযোদ্ধা।***]
....................................................................................................................................................................................................................................................................

মৈত্রী ভাবনা হল সকলের প্রতি মৈত্রী ভাব পোষণ করা।



মৈত্রী ভাবনা হল সকলের প্রতি মৈত্রী  কামনা করা। মনের গভীরে যদি কারও প্রতি ঘৃণা, ক্ষোভ, হিংসা, লুকিয়ে থাকে কিংবা কারও সাথে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে তা বিদুরিত করতে মৈত্রী ভাবনা করতে হয়। এই ভাবনার গুণাগুণ বর্ণণাতীত। একাগ্রতার সাথে সঠিক পন্থায় ভাবনা অনুশীলন করলে এর ফল প্রত্যক্ষ। মৈত্রী ভাবনার বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলন রয়েছে । তন্মধ্যে একটি পদ্ধতি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল।
মৈত্রী ভাবনা শুরুর নিয়মাবলীঃ
ভাবনা শুরুর পূর্বে হাতমূখ ধুয়ে  সম্ভব হলে গোসল করে প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করলে মন নিবিষ্ঠ হবে এবং ভাবনা করতে সুবিধা হবে। এরপর ত্রিশরণ গ্রহণ করে ভাবনা শুরু করতে হবে,সম্ভব হলে পঞ্চশীল অধিস্থান করে নিতে পারেন। এরপর নিরিবিলি একটা জায়গা নির্বাচন করে ভদ্রাসনে কিংবা পদ্মাসনে কোমর সোজা রেখে বসতে হবে। কোলের উপরে বাম হাতের তালুর উপর ডান হাত রাখতে হবে। উভয় হাতের তালু উর্দ্ধমূখী থাকবে এবং দুচোখ আলতো করে বন্ধ রাখতে হবে। এবার মনে মনে বলুন-
.          আমি সুখী হই, রোগমুক্ত হই, বিপদমুক্ত হই, শত্রুমুক্ত হই সুখে জীবন যাপন করি(এভাবে ৩/৫ মিনিট মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে ভাবনা করুন)।
.          আমার অনুরূপ আমার বাবা-মাও সুখী হোক, রোগমুক্ত হোক, বিপদমুক্ত হোক, শত্রুমুক্ত হোক সুখে জীবন যাপন করুক(এভাবে ৩/৫ মিনিট মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে ভাবনা করুন)।
.          এরপর ভাবুন, আমার শিক্ষকবৃন্দ এবং বয়োজ্যষ্ঠগণও আমার অনুরূপ সুখী হোক, রোগমুক্ত হোক, বিপদমুক্ত হোক, শত্রুমুক্ত হোক সুখে জীবন যাপন করুক(এভাবে ৩/৫ মিনিট মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে ভাবনা করুন)।
.          আমার অনুরূপ আমার ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনরাও সুখী হোক, রোগমুক্ত হোক, বিপদমুক্ত হোক, শত্রুমুক্ত হোক সুখে জীবন যাপন করুক(এভাবে ৩/৫ মিনিট মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে ভাবনা করুন)।
.          আমার অনুরূপ আমার বন্ধুরাও সুখী হোক, রোগমুক্ত হোক, বিপদমুক্ত হোক, শত্রুমুক্ত হোক সুখে জীবন যাপন করুক(এভাবে ৩/৫ মিনিট মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে ভাবনা করুন)।
.          এরপর আপনার পরিচিত কিন্তু ঘনিষ্ঠ নন্ এমন ব্যক্তিদের মঙ্গল কামনা করে ভাবুন- আমার অনুরূপ তারাও সুখী হোক, রোগমুক্ত হোক, বিপদমুক্ত হোক, শত্রুমুক্ত হোক সুখে জীবন যাপন করুক(এভাবে ৩/৫ মিনিট মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে ভাবনা করুন)।
.          সবশেষে, যে/যাদের সাথে আপনার সুসম্পর্ক নেই, যে/যাদের আপনি সহ্য করতে পারেন না অথবা আপনাকে সহ্য করতে পারে না, শত্রুতা সম্পর্ক বিদ্যমান তাদের মঙ্গল কামনা করে ভাবুন- তারাও সুখী হোক, রোগমুক্ত হোক, বিপদমুক্ত হোক, শত্রুমুক্ত হোক সুখে জীবন যাপন করুক(এভাবে ৩/৫ মিনিট মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে ভাবনা করুন)।








সৌভাগ্য ও অদৃষ্ট- ভদন্ত এস ধাম্মিকা


প্রশ্নঃ- তান্ত্রিকতা ও ভাগ্যগণনা সম্পর্কে বুদ্ধর অভিমত কি?
উত্তরঃ ভাগ্য গণনা, রক্ষাকবচ এবং গৃহনির্মাণ ও যাত্রায় শুভ অশুভ দিন ধায্যকরণকে বু্দ্ধ অর্থহীন কুসংষ্কার আখ্যায়িত করে তাঁর অনুসারীদের এই আচারাদি পালন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
প্রশ্নঃ- এতে কোনও সত্যতা না থাকলে অনেকে কেন তান্ত্রিকতা বিশ্বাস ও চর্চা করেন?
উত্তরঃ লোভ, ভয় ও অজ্ঞতার কারণে এগুলির চর্চা করা হয়। বুদ্ধের উপদেশ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, এক টুকরা কাগজ, ধাতব মুদ্রাখন্ড, কিংবা অন্য কোনও পাথর কণা অপেক্ষা মানুষের মহহৃদয়বৃত্তিজাত কুশলকর্ম অনেক বেশী শক্তিশালী। বুদ্ধের গভীর সাধনালব্দ বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান-আলোকে মানুষ সদাচার, করুণা, ক্ষমা, ধৈয্য, ত্যাগ ও সততাধর্মী জীবনাচারের সাহায্যে প্রকৃতপক্ষে অশুভ ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে পারেন। তাই তান্ত্রিকতার আচার অনুষ্ঠানকে তিনি নিম্নমানের বৃত্তি বা জীবীকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
প্রশ্নঃ- কিছু তান্ত্রিকতা কায্যকরী বলে শোনা যায়, তাই নয় কি?
উত্তরঃ লক্ষ্য করবেন, যাঁরা ঐ পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের দাবি হলো ভাগ্য পরিবর্তন করে তারা সৌভাগ্যের গ্যারান্টি দিতে পারেন। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে তারা নিজেরা কেন বিপুল সম্পত্তির অধিকারী নন?  তাঁরা কেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন না? কেন প্রতি সপ্তায় লটারী জিতে মোটা অর্থ লাভ করেন না? আসল কথা হলো তাদের এইটুকু ভাগ্য যে, কিছু বোকা বা অজ্ঞ মানুষ পাথর কিংবা রক্ষাকবচ ক্রয় করে তাদের জীবিকা অর্জনে সাহায্য করেন। এখানে সাধারণ মানুষের মনে অলীক বিশ্বাস ও মোহ সৃষ্টি করে তা স্বার্থসিদ্ধির কজে লাগানো হয়।
প্রশ্নঃ- ভাগ্য বলে কি কিছুই নেই?
উত্তরঃ ভাগ্য বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, এমন অদৃশ্য শক্তিকে, যা খেয়াল খুশিমত মানুষের ভাল-মন্দ নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু বৌদ্ধ দর্শন ও বিজ্ঞানের কার্যকারণ প্রক্রিয়া মতে জগত জীবনে সুনিদিষ্ট কারণ ছাড়া কোন ঘটনা ঘটে না। এখানে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কোন অবকাশ নেই। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে রোগাগ্রস্ত হয়। এখানে সুনির্দিষ্ট রোগ হলো ঘটনা; সুনির্দিষ্ট রোগ জীবাণু এবং দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা হলো কারণ। চিকিসার সাহায্যে কারণ দূর করলে রোগ নিরাময় হয়। এখানে রোগ জীবাণু ও ঔষধ এই দুইটি জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ করে না। তান্ত্রিক শাস্ত্রের কোন কাগজের টুকরো বা ধাতব পদার্থ খন্ড, কিংবা পাথরে লিখা কোন ধর্মীয় বাণী কিংবা পাঠ করে মন্ত্র ধারণ করলেরোগ প্রতিরোধ বা নিরাময়ে কার্যকরী হবার কোন কারণ নেই। মানুষের কুশল অকুশল ঘটনার কারণ হলো- মানুষের কৃত কুশল-অকুশল জীবনাচরণধর্মী কর্ম। যাঁরা অলৌকিকতার ভাগ্যে বিশ্বাস করেন, তাঁরা সাধারণতঃ অনিয়ন্ত্রিত অর্থ-সম্পদের চাহিদার পেছনে অন্তহীন অসন্তুষ্টি নিয়ে ছুটে চলেন। বুদ্ধ বলেছেন, সুশিক্ষিত, সুদক্ষ, বিভিন্ন বিষয়ে সুনিপুণ এবং সুভাষী হওয়া উত্তম মঙ্গলকারক, পরম সৌভাগ্যদায়ী।
মাতা-পিতার সেবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার ভরণ পোষন, সাধাসিধে জীবন যাপন করা উত্তম মঙ্গল, পরম সৌভাগ্যদায়ী।
ত্যাগী হওয়া, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, অভাবগ্রস্তদের সাহায্য এবং নিদোর্ষ কর্মসম্পাদন করা উত্তম মঙ্গল, পরম সৌভাগ্যদায়ী।
কৃতজ্ঞ, সন্তুষ্ট, শ্রদ্ধাবান, বিনম্রী মানবতাবোধ হওয়া, সদ্ধর্ম শ্রবণ করা উত্তম মঙ্গল এবং পরম সৌভাগ্য দায়ী। উক্ত কর্মক্রিয়াই মানুষের শুভ-অশুভ ফলাফল প্রদান করতে সক্ষম; অন্য কিছু নয়
[*** অসবন্ধুর সঙ্গ বর্জন করো, সবন্ধুর সঙ্গলাভ করো,মহব্যক্তির সংস্পর্শে গমন করো।***
*** যিনি পন্ডিত ও প্রবীন ব্যক্তিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করেন, তিনি দীর্ঘায়ু, যশ, সুখ, শান্তি- সম্পদ লাভ করেন।***]
........................................................................................................