প্রশ্নঃ- বৌদ্ধরা কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
উত্তরঃ না, বৌদ্ধেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। এর স্বপক্ষে কয়েকটি যুক্তি আছে। আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতো বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরে বিশ্বাসের বিষয়টি মানুষের মনের ভয়-ভীতি থেকে সৃষ্ট। বুদ্ধ বলেছেন, ভয়ার্থ মানুষ তথাকথিত পবিত্র পাহাড়-পর্বতে, গুহায়, পবিত্র বৃক্ষের তলায় কিংবা দেব-দেবীর স্মৃতি মন্দিরে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। আদিম অধিবাসী মানুষকে ভয়াবহ বিপদজনক প্রতিকূল পরিবেশে বসবাস করতে হতো। চারপাশে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয়, ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব, শারিরীক আঘাত ও রোগের যন্ত্রণা, বিদ্যুৎ চমকানো বজ্রাঘাত এবং আগ্নেয়গিরির ভয় সংকুল পরিবেশে মানুষ নিজেকেঅসহায় বোধ করতো। কোথাও নিরাপত্তা খুজেঁ না পেয়ে ভয়ার্থ মানুষ নিরাপত্তার আশ্রয় হিসেবে ঈশ্বর কল্পনা করেন। ঈশ্বরের কাছে বিপদের সময় সাহস, দুঃসময়ে সান্তনা এবং সুসময়ে স্বস্তি লাভ করেন। আপনি লক্ষ্য করবেন বিপদে পড়লে মানুষ বেশী ধার্মীক হয়ে উঠেন। বিপদ সংকট উত্তরণের জন্য দেব-দেবী বা কোন অদৃশ্য শক্তির কাছে প্রার্থনা করা হয়, যাতে সেই শক্তি বিপদশুক্ত করেন। এতে বিপদগ্রস্ত মানুষের মনে সাহসের সঞ্চার হয়। যাঁরা যেই দেব-দেবীতে বিশ্বাসী, তাদেঁর প্রার্থনা অভিষ্ট সেই দেব-দেবী শোনেন এবং সাড়া দেন বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, অজ্ঞতা জনিত ভয়ের কারণে ঐরূপ বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। ভয়ের কারণ বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তির সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে , হতাশার কারণ অনিয়ন্ত্রিত ভোগতৃঞ্চা প্রশমিত করতে এবং অপ্রতিরোধ্য বিষয়গুলোকে শান্ত, ধৈর্যশীল ও সাহসী হয়ে মোকাবিলা করার জন্য বুদ্ধের উপদেশ প্রণিধানযোগ্য।
ঈশ্বরে বিশ্বাস না করার দ্বিতীয় কারণ হলো ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব। ঈশ্বরে বিশ্বাসী ধর্মগ্রন্থ সমূহে ঈশ্বর বিশ্বাস সম্পর্কে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে উদ্ধৃত বিষয়সমূহ সঠিক, অন্যদের সঠিক নয় বলে দাবি করা হয়। কেউ ঈশ্বরকে পুরুষ, কেউ ঈশ্বরকে নারী, আবার কেউ ক্লিব হিসেবে বিশ্বাস করেন। প্রত্যেকের নিজ নিজ বিশ্বাস সত্য, অন্যদের বিশ্বাস মিথ্যা বলে দাবি ও উপহাস করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, বিগত শত শত বছর ধরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে তর্ক বিতর্কের উর্ধে, সুনিশ্চিত ও বিজ্ঞানসম্মত কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। সেই কারণে, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত, বৌদ্ধরা বিষয়টি মুতবি রেখে দিতে চান।
ঈশ্বরে বিশ্বাস না করার তৃতীয় কারণ হলো, শুদ্ধ সার্থক জীবন যাপনে ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। অনেকে মনে করতে পারেন, বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির রহস্য উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এই রুপ কোন বিশ্বাস ছাড়াই সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। আবার কেউ মনে করেন, সুখী ও উৎকণ্ঠাহীন জীবনযাপনে ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রয়োজন। এ কথাও ঠিক বলে মনে হয় না।শুধুমাত্র বৌদ্ধরা নন্, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন, যাঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন্। তাঁরা অন্যান্যদের মত কার্যকারণের নিয়মে কর্মফল ভোগ করে জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। আবার অনেকে মনে করেন, নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চারের জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রয়োজন। কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন্, এমন অনেকে আছেন, যাঁরা আত্মবিশ্বাস ও নিজেদের কর্মোদ্যমে বাঁধা-বিপত্তি ও পঙ্গুত্বের অক্ষমতা অতিক্রম করে সফলতার চুড়াঁয় আরোহণ করেছেন।আবার কেউ মনে করেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস আত্মমুক্তির সহায়ক। বুদ্ধ নিজের সাধনলদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, প্রতিটি মানুষ মনের কলুষ দূর করে, মৈত্রী করুণার আদেশে জীবনযাপনে প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারেন এবং আপন প্রজ্ঞা শক্তিতে অভিষ্ট লক্ষ্য অজর্ন করতে সক্ষম। বুদ্ধ মানুষের দৃষ্টিকে অলৌকিক ঈশ্বর কেন্দ্রিকতা থেকে মানবকেন্দ্রিকতায় ফিরিয়ে এসেছেন এবং আত্মশক্তি দিয়ে নিজ সমস্যা সমাধানে মানুষকে উজ্জিবীত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে অলৌকিক কল্পনাশ্রিত শক্তি অপেক্ষা অভিজ্ঞচালক আত্মশক্তি অনেক বেশী শক্তিশালী। প্রাকৃতিক কার্যকারণে, নিজ নিজ শৃদ্ধ অশুদ্ধ জীবনাচরণগত কর্মই প্রত্যক মানুষের শুভ অশুভ কর্মফল প্রদান করে। দ্বিতীয় অদৃশ্য কোন শক্তির এখানে ভূমিকা নেই।
['অর্থব, উদ্যমহীন অশ্বকে পেছনে ফেলে সক্রিয় উদ্যোগী বেগবান অশ্ব যেমন এগিয়ে চলে, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবানরা তেমনি নিষ্ক্রয়দের মধ্যে সক্রিয়, সুপ্তদের মধ্যে জাগ্রত এবং ক্রোধীদের মধ্যে অক্রোধী হয়ে প্রগতির দিকে এগিয়ে চলে।']
প্রশ্নঃ- যদি সৃষ্টিকর্তা না থাকে তাহলে বিশ্বমন্ডল হলো কি করে?
উত্তরঃ ঈশ্বরে বিশ্বাসী সব ধর্মই কাল্পনিক ও পৌরনিক কাহিনীর সাহায়্যে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করছে। একবিংশ শতাব্দীতে পদার্থ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞানের তথ্যের কাছে পৌরনিক কল্পকাহিনী এখন গুরুথ্ব হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়াই সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন করে ফেলেছে, যা বৈজ্ঞানিক তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রশ্নঃ-বিশ্ব মন্ডলের সৃষ্টি সম্পর্কে বুদ্ধ কি বলেছেন?
উত্তরঃ এ সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান এবং বুদ্ধের ব্যাখ্যা অভিন্ন। "অগ্গঞা সূত্রে" বুদ্ধের ব্যাখ্যা হলো, লক্ষ লক্ষ বছরের দীর্ঘ সময় ব্যাপী প্রাকৃতিক বিবর্তনের ধারায় সৌরমন্ডল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় সৌরমন্ডলের বর্তমান ঘূর্ণায়মান অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বপ্রকৃতির প্রথম প্রাণীর সৃষ্টি হয় জলে, এককোষী প্রাণী হিসেবে। পরবর্তী পর্যায়ে বিবর্তনের মাধ্যমে এককোষী প্রাণী বহুকোষী যৌগিক প্রাণীতে রুপান্তরীত হয়। প্রাকৃতিক কার্য-কারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই রুপান্তর ঘটেছে, যা বুদ্ধের "প্রতীত্য সমুৎপাদ সূত্রে"ও দেশিত হয়েছে।
প্রশ্নঃ-আপনি বলছেন, সৃষ্টির রহস্য ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়া প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে অলৌকিক ঘটনাগুলো কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
উত্তরঃ অনেকে বিশ্বাস করেন, অলৌকিক ঘটনাগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ। কিন্তু অলৌকিক উপায়ে কোন রোগ নিরাময় হতে পারে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সমর্থন পাওয়া যায় না। জনশ্রুতিতে শোনা যায়, কেউ বিপর্যয় থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় তা ঘটেছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। রোগাক্রান্ত বেঁকে যাওয়া শরীর সোজা হয়ে গেছে, পক্ষাঘাতে অবশ প্রত্যঙ্গ শক্তি ফিরে পেয়েছে ইত্যাদি ঘটনা অলৌকিকভাবে ঘটেছে বলে দাবী করা হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষায় তার সত্যতা প্রমাণ করে না। জনশ্রুতি, অসমর্থিত দাবী কখনো প্রমাণিত সত্যের বিকল্প হতে পারেনা। ব্যখ্যা করা যায় না কিংবা প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলে না এমন ঘটনা কখনো কখনো ঘটে থাকে। এর ব্যখ্যা করার ক্ষমতা আমাদের জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা প্রমাণ করে, কিন্তু তাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। আধূনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির আগে রোগে আক্রান্ত হওয়াকে কোন দেবদেবী বা ঈশ্বরের শাস্তি বলে বিশ্বাস করা হতো। এখন রোগের কারণ জানা গেছে, রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা করে রোগ নিরাময় হয়। ভবিষ্যতে আমাদের জ্ঞান পরিধি আরও বিস্তৃত হলে আজকের অজানা অনেক রহস্য উম্মোচিত হবে, যেমন এখন আমরা অনেক রোগের কারণ বুঝতে সক্ষম হয়েছি।
প্রশ্নঃ- অনেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব কোনো না কোনোভাবে বিশ্বাস করেন। এখানে সত্য নিহিত আছে, এই কথা কি বলা যায় না?
উত্তরঃ না, তা বলা যায় না। এক সময় ভূ-মন্ডলকে চ্যাপ্ট বলে মনে করা হতো। কিন্তু পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিপৃল সংখ্যক মানুষ কিছু বিশ্বাস করে বলে, তা সত্য - এ কথা বলা যায় না। সত্য মিথ্যা নিরুপন করা উচিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে।
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলে কিসে বিশ্বাস করেন?
উত্তরঃ আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমরা মানুষের অপরিমেয় শক্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষ মূল্যবান এবং প্রতিটি মানুষের মধ্যে অনন্ত মেধা সুপ্ত আছে। কর্মসাধনায় প্রতিটি মানুষ বুদ্ধের মত প্রজ্ঞা লাভ করে কোন বিষয় আসলে যে রকম ঠিক সেই রকম প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি, মনের ঈর্ষা, ক্রোধ ও ঘৃণার স্থলে করুণা, ক্ষমা ও মৈত্রীর অনূভূতিতে উজ্জিবীত হয়ে প্রতিটি মানুষ নিজ জ্ঞানশক্তির সাহায্যে জীবন জগতের সকল সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। বুদ্ধ বলেছেন আমাদের অন্য কেউ রক্ষা করতে পারে না, নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে হয়।
অজ্ঞতা ধূর করে জ্ঞানের আলোকে জীবনের স্বরুপ জ্ঞাত হয়ে আপন কর্মশক্তির সাহায্যে নিজ নিজ সমস্যা সমাধান করতে হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার জ্ঞানাআলোকে বুদ্ধ স্পষ্ট ভাবে সেই পথ চলার সন্ধান দিয়েছেন।
প্রশ্নঃ- অন্য ধর্মের অনুসারীরা তাদেঁর দেবদেবীর নির্দেশিত উপায়ে কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা তা নির্ধারণ করেন। আপনি তো ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, কি করে নির্ধারণ করেন- কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা?
উত্তরঃ যে চিন্তা-ভাবনা-বাক্য কিংবা কর্ম ঈর্ষা, লোভ, ঘৃণা ও মোহের শেখরে আবদ্ধ, তা মন্দ ও অমঙ্গলদায়ক এবং নির্বাণের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। যে চিন্তা-ভাবনা-বাক্য বা কর্ম; ত্যাগ, ক্ষমা, মৈত্রী, করুণা ও প্রজ্ঞার শেখরে নিবদ্ধ, তা সত্য, মঙ্গল ও উত্তম এবং নির্বাণের পথে নিয়ে যায়। ঈশ্বর নির্ভর ধর্ম দর্শনে আপনাকে যা করতে নির্দেশ দেয়া হয়, তাই করতে হয়। কিন্তু মানবকেন্দ্রিক ও যুক্তি নির্ভর বৌদ্ধ দর্শনে নিজের আত্মশক্তির বিচার বিশ্লেষণে, আত্মোপলদ্ধির সাহায্যে কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা, কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ কোনটি মঙ্গলজনক, কোনটি অমঙ্গলজনক তা নির্ধারণ করতে পারেন।
জ্ঞান ভিত্তিক নৈতিকতা, আদেশ-নির্দেশ নির্ভর নৈতিকতার চাইতে অবশ্যই অধিকতর শক্তিশালী। কেননা প্রথমটি বিচার বিশ্লেষণের উপর, দ্বিতীয়টি বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল।
অনুরুপভাবে, কোনটি সত্যাশ্রয়ী, কোনটি মিথ্যাশ্রয়ী, কোনটি নিজের এবং অন্যের জন্য মঙ্গলজনক তা নিরুপনের জন্য বুদ্ধ তিনটি বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেনঃ
১) যদি উদ্দেশ্য সত্যাশ্রয়ী হয় অর্থাৎ যে কর্ম ভালোবাসা ও প্রজ্ঞা উদ্ভূত,
২) যে কর্মফল নিজের সহায়ক হয় অর্থাৎ কর্ম যদি নিজেকে অধিকতর ত্যাগী, মৈত্রীপূর্ণ ও প্রজ্ঞাবান করতে সক্ষম হয়,
৩) যে কর্ম অন্যের জন্য উপকারী অর্থাৎ যে কর্ম অন্যকে অধিকতর ত্যাগী, মৈত্রীভাবাপন্ন ও প্রজ্ঞাবান করতে সাহায্য করে, সেই কর্ম সম্পাদনই সত্যাশ্রয়ী, উত্তম, নৈতিক এবং সর্বাঙ্গীন মঙ্গলময়। তবে কার্যকারণ প্রক্রিয়ার সুক্ষ্ম বিচারে আপাতদৃষ্টিতে ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যেমনঃ সৎ উদ্দেশ্যে কোন কর্ম বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা আমার ও অন্যের মঙ্গলদায়ক মনে না হতে পারে। আবার কখনো কখনো আমার সৎ উদ্দেশ্যে কৃত কর্ম আমার জন্য মঙ্গলদায়ক হলো, কিন্ত অন্যের জন্য কষ্টদায়ক মনে হতে পারে। তবে মিথ্যশ্রয়ী কর্ম সম্পদনের ফল, আমার এবং অন্যের জন্য অবশ্যই কষ্টদায়ক হবে। কুশলধর্মী কর্মের ফল আমার এবং অন্যের জন্য সর্বাঙ্গীন মঙ্গলদায়ক হবে। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মের ফলপ্রাপ্তি শুধু সময়ের ব্যাপার। বুদ্ধ বিচার বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সত্যাশ্রয়ী ও মিথ্যাশ্রয়ী কর্ম সম্পাদনের এবং কর্মফল প্রাপ্তির ব্যাখ্যা করেছেন। প্রকৃতির নিয়ম রাজ্যে কার্যকারণ প্রক্রিয়ার এমন বিধান কার্যকরী, যার প্রভাবেই যথাযথ কর্মের যথাযথ ফলের সৃষ্টি হয়। এটিই বুদ্ধের দীর্ঘ ৬বছর কঠোর সাধনালদ্ধ এবং অভিজ্ঞতালদ্ধ সত্যোৎঘাটন।
উত্তরঃ না, বৌদ্ধেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। এর স্বপক্ষে কয়েকটি যুক্তি আছে। আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতো বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরে বিশ্বাসের বিষয়টি মানুষের মনের ভয়-ভীতি থেকে সৃষ্ট। বুদ্ধ বলেছেন, ভয়ার্থ মানুষ তথাকথিত পবিত্র পাহাড়-পর্বতে, গুহায়, পবিত্র বৃক্ষের তলায় কিংবা দেব-দেবীর স্মৃতি মন্দিরে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। আদিম অধিবাসী মানুষকে ভয়াবহ বিপদজনক প্রতিকূল পরিবেশে বসবাস করতে হতো। চারপাশে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয়, ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব, শারিরীক আঘাত ও রোগের যন্ত্রণা, বিদ্যুৎ চমকানো বজ্রাঘাত এবং আগ্নেয়গিরির ভয় সংকুল পরিবেশে মানুষ নিজেকেঅসহায় বোধ করতো। কোথাও নিরাপত্তা খুজেঁ না পেয়ে ভয়ার্থ মানুষ নিরাপত্তার আশ্রয় হিসেবে ঈশ্বর কল্পনা করেন। ঈশ্বরের কাছে বিপদের সময় সাহস, দুঃসময়ে সান্তনা এবং সুসময়ে স্বস্তি লাভ করেন। আপনি লক্ষ্য করবেন বিপদে পড়লে মানুষ বেশী ধার্মীক হয়ে উঠেন। বিপদ সংকট উত্তরণের জন্য দেব-দেবী বা কোন অদৃশ্য শক্তির কাছে প্রার্থনা করা হয়, যাতে সেই শক্তি বিপদশুক্ত করেন। এতে বিপদগ্রস্ত মানুষের মনে সাহসের সঞ্চার হয়। যাঁরা যেই দেব-দেবীতে বিশ্বাসী, তাদেঁর প্রার্থনা অভিষ্ট সেই দেব-দেবী শোনেন এবং সাড়া দেন বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, অজ্ঞতা জনিত ভয়ের কারণে ঐরূপ বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। ভয়ের কারণ বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তির সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে , হতাশার কারণ অনিয়ন্ত্রিত ভোগতৃঞ্চা প্রশমিত করতে এবং অপ্রতিরোধ্য বিষয়গুলোকে শান্ত, ধৈর্যশীল ও সাহসী হয়ে মোকাবিলা করার জন্য বুদ্ধের উপদেশ প্রণিধানযোগ্য।
ঈশ্বরে বিশ্বাস না করার দ্বিতীয় কারণ হলো ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব। ঈশ্বরে বিশ্বাসী ধর্মগ্রন্থ সমূহে ঈশ্বর বিশ্বাস সম্পর্কে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে উদ্ধৃত বিষয়সমূহ সঠিক, অন্যদের সঠিক নয় বলে দাবি করা হয়। কেউ ঈশ্বরকে পুরুষ, কেউ ঈশ্বরকে নারী, আবার কেউ ক্লিব হিসেবে বিশ্বাস করেন। প্রত্যেকের নিজ নিজ বিশ্বাস সত্য, অন্যদের বিশ্বাস মিথ্যা বলে দাবি ও উপহাস করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, বিগত শত শত বছর ধরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে তর্ক বিতর্কের উর্ধে, সুনিশ্চিত ও বিজ্ঞানসম্মত কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। সেই কারণে, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত, বৌদ্ধরা বিষয়টি মুতবি রেখে দিতে চান।
ঈশ্বরে বিশ্বাস না করার তৃতীয় কারণ হলো, শুদ্ধ সার্থক জীবন যাপনে ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। অনেকে মনে করতে পারেন, বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির রহস্য উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এই রুপ কোন বিশ্বাস ছাড়াই সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। আবার কেউ মনে করেন, সুখী ও উৎকণ্ঠাহীন জীবনযাপনে ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রয়োজন। এ কথাও ঠিক বলে মনে হয় না।শুধুমাত্র বৌদ্ধরা নন্, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন, যাঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন্। তাঁরা অন্যান্যদের মত কার্যকারণের নিয়মে কর্মফল ভোগ করে জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। আবার অনেকে মনে করেন, নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চারের জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রয়োজন। কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন্, এমন অনেকে আছেন, যাঁরা আত্মবিশ্বাস ও নিজেদের কর্মোদ্যমে বাঁধা-বিপত্তি ও পঙ্গুত্বের অক্ষমতা অতিক্রম করে সফলতার চুড়াঁয় আরোহণ করেছেন।আবার কেউ মনে করেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস আত্মমুক্তির সহায়ক। বুদ্ধ নিজের সাধনলদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, প্রতিটি মানুষ মনের কলুষ দূর করে, মৈত্রী করুণার আদেশে জীবনযাপনে প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারেন এবং আপন প্রজ্ঞা শক্তিতে অভিষ্ট লক্ষ্য অজর্ন করতে সক্ষম। বুদ্ধ মানুষের দৃষ্টিকে অলৌকিক ঈশ্বর কেন্দ্রিকতা থেকে মানবকেন্দ্রিকতায় ফিরিয়ে এসেছেন এবং আত্মশক্তি দিয়ে নিজ সমস্যা সমাধানে মানুষকে উজ্জিবীত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে অলৌকিক কল্পনাশ্রিত শক্তি অপেক্ষা অভিজ্ঞচালক আত্মশক্তি অনেক বেশী শক্তিশালী। প্রাকৃতিক কার্যকারণে, নিজ নিজ শৃদ্ধ অশুদ্ধ জীবনাচরণগত কর্মই প্রত্যক মানুষের শুভ অশুভ কর্মফল প্রদান করে। দ্বিতীয় অদৃশ্য কোন শক্তির এখানে ভূমিকা নেই।
['অর্থব, উদ্যমহীন অশ্বকে পেছনে ফেলে সক্রিয় উদ্যোগী বেগবান অশ্ব যেমন এগিয়ে চলে, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবানরা তেমনি নিষ্ক্রয়দের মধ্যে সক্রিয়, সুপ্তদের মধ্যে জাগ্রত এবং ক্রোধীদের মধ্যে অক্রোধী হয়ে প্রগতির দিকে এগিয়ে চলে।']
প্রশ্নঃ- যদি সৃষ্টিকর্তা না থাকে তাহলে বিশ্বমন্ডল হলো কি করে?
উত্তরঃ ঈশ্বরে বিশ্বাসী সব ধর্মই কাল্পনিক ও পৌরনিক কাহিনীর সাহায়্যে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করছে। একবিংশ শতাব্দীতে পদার্থ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞানের তথ্যের কাছে পৌরনিক কল্পকাহিনী এখন গুরুথ্ব হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়াই সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন করে ফেলেছে, যা বৈজ্ঞানিক তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রশ্নঃ-বিশ্ব মন্ডলের সৃষ্টি সম্পর্কে বুদ্ধ কি বলেছেন?
উত্তরঃ এ সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান এবং বুদ্ধের ব্যাখ্যা অভিন্ন। "অগ্গঞা সূত্রে" বুদ্ধের ব্যাখ্যা হলো, লক্ষ লক্ষ বছরের দীর্ঘ সময় ব্যাপী প্রাকৃতিক বিবর্তনের ধারায় সৌরমন্ডল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় সৌরমন্ডলের বর্তমান ঘূর্ণায়মান অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বপ্রকৃতির প্রথম প্রাণীর সৃষ্টি হয় জলে, এককোষী প্রাণী হিসেবে। পরবর্তী পর্যায়ে বিবর্তনের মাধ্যমে এককোষী প্রাণী বহুকোষী যৌগিক প্রাণীতে রুপান্তরীত হয়। প্রাকৃতিক কার্য-কারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই রুপান্তর ঘটেছে, যা বুদ্ধের "প্রতীত্য সমুৎপাদ সূত্রে"ও দেশিত হয়েছে।
প্রশ্নঃ-আপনি বলছেন, সৃষ্টির রহস্য ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়া প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে অলৌকিক ঘটনাগুলো কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
উত্তরঃ অনেকে বিশ্বাস করেন, অলৌকিক ঘটনাগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ। কিন্তু অলৌকিক উপায়ে কোন রোগ নিরাময় হতে পারে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সমর্থন পাওয়া যায় না। জনশ্রুতিতে শোনা যায়, কেউ বিপর্যয় থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় তা ঘটেছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। রোগাক্রান্ত বেঁকে যাওয়া শরীর সোজা হয়ে গেছে, পক্ষাঘাতে অবশ প্রত্যঙ্গ শক্তি ফিরে পেয়েছে ইত্যাদি ঘটনা অলৌকিকভাবে ঘটেছে বলে দাবী করা হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষায় তার সত্যতা প্রমাণ করে না। জনশ্রুতি, অসমর্থিত দাবী কখনো প্রমাণিত সত্যের বিকল্প হতে পারেনা। ব্যখ্যা করা যায় না কিংবা প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলে না এমন ঘটনা কখনো কখনো ঘটে থাকে। এর ব্যখ্যা করার ক্ষমতা আমাদের জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা প্রমাণ করে, কিন্তু তাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। আধূনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির আগে রোগে আক্রান্ত হওয়াকে কোন দেবদেবী বা ঈশ্বরের শাস্তি বলে বিশ্বাস করা হতো। এখন রোগের কারণ জানা গেছে, রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা করে রোগ নিরাময় হয়। ভবিষ্যতে আমাদের জ্ঞান পরিধি আরও বিস্তৃত হলে আজকের অজানা অনেক রহস্য উম্মোচিত হবে, যেমন এখন আমরা অনেক রোগের কারণ বুঝতে সক্ষম হয়েছি।
প্রশ্নঃ- অনেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব কোনো না কোনোভাবে বিশ্বাস করেন। এখানে সত্য নিহিত আছে, এই কথা কি বলা যায় না?
উত্তরঃ না, তা বলা যায় না। এক সময় ভূ-মন্ডলকে চ্যাপ্ট বলে মনে করা হতো। কিন্তু পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিপৃল সংখ্যক মানুষ কিছু বিশ্বাস করে বলে, তা সত্য - এ কথা বলা যায় না। সত্য মিথ্যা নিরুপন করা উচিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে।
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলে কিসে বিশ্বাস করেন?
উত্তরঃ আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমরা মানুষের অপরিমেয় শক্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষ মূল্যবান এবং প্রতিটি মানুষের মধ্যে অনন্ত মেধা সুপ্ত আছে। কর্মসাধনায় প্রতিটি মানুষ বুদ্ধের মত প্রজ্ঞা লাভ করে কোন বিষয় আসলে যে রকম ঠিক সেই রকম প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি, মনের ঈর্ষা, ক্রোধ ও ঘৃণার স্থলে করুণা, ক্ষমা ও মৈত্রীর অনূভূতিতে উজ্জিবীত হয়ে প্রতিটি মানুষ নিজ জ্ঞানশক্তির সাহায্যে জীবন জগতের সকল সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। বুদ্ধ বলেছেন আমাদের অন্য কেউ রক্ষা করতে পারে না, নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে হয়।
অজ্ঞতা ধূর করে জ্ঞানের আলোকে জীবনের স্বরুপ জ্ঞাত হয়ে আপন কর্মশক্তির সাহায্যে নিজ নিজ সমস্যা সমাধান করতে হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার জ্ঞানাআলোকে বুদ্ধ স্পষ্ট ভাবে সেই পথ চলার সন্ধান দিয়েছেন।
প্রশ্নঃ- অন্য ধর্মের অনুসারীরা তাদেঁর দেবদেবীর নির্দেশিত উপায়ে কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা তা নির্ধারণ করেন। আপনি তো ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, কি করে নির্ধারণ করেন- কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা?
উত্তরঃ যে চিন্তা-ভাবনা-বাক্য কিংবা কর্ম ঈর্ষা, লোভ, ঘৃণা ও মোহের শেখরে আবদ্ধ, তা মন্দ ও অমঙ্গলদায়ক এবং নির্বাণের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। যে চিন্তা-ভাবনা-বাক্য বা কর্ম; ত্যাগ, ক্ষমা, মৈত্রী, করুণা ও প্রজ্ঞার শেখরে নিবদ্ধ, তা সত্য, মঙ্গল ও উত্তম এবং নির্বাণের পথে নিয়ে যায়। ঈশ্বর নির্ভর ধর্ম দর্শনে আপনাকে যা করতে নির্দেশ দেয়া হয়, তাই করতে হয়। কিন্তু মানবকেন্দ্রিক ও যুক্তি নির্ভর বৌদ্ধ দর্শনে নিজের আত্মশক্তির বিচার বিশ্লেষণে, আত্মোপলদ্ধির সাহায্যে কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা, কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ কোনটি মঙ্গলজনক, কোনটি অমঙ্গলজনক তা নির্ধারণ করতে পারেন।
জ্ঞান ভিত্তিক নৈতিকতা, আদেশ-নির্দেশ নির্ভর নৈতিকতার চাইতে অবশ্যই অধিকতর শক্তিশালী। কেননা প্রথমটি বিচার বিশ্লেষণের উপর, দ্বিতীয়টি বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল।
অনুরুপভাবে, কোনটি সত্যাশ্রয়ী, কোনটি মিথ্যাশ্রয়ী, কোনটি নিজের এবং অন্যের জন্য মঙ্গলজনক তা নিরুপনের জন্য বুদ্ধ তিনটি বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেনঃ
১) যদি উদ্দেশ্য সত্যাশ্রয়ী হয় অর্থাৎ যে কর্ম ভালোবাসা ও প্রজ্ঞা উদ্ভূত,
২) যে কর্মফল নিজের সহায়ক হয় অর্থাৎ কর্ম যদি নিজেকে অধিকতর ত্যাগী, মৈত্রীপূর্ণ ও প্রজ্ঞাবান করতে সক্ষম হয়,
৩) যে কর্ম অন্যের জন্য উপকারী অর্থাৎ যে কর্ম অন্যকে অধিকতর ত্যাগী, মৈত্রীভাবাপন্ন ও প্রজ্ঞাবান করতে সাহায্য করে, সেই কর্ম সম্পাদনই সত্যাশ্রয়ী, উত্তম, নৈতিক এবং সর্বাঙ্গীন মঙ্গলময়। তবে কার্যকারণ প্রক্রিয়ার সুক্ষ্ম বিচারে আপাতদৃষ্টিতে ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যেমনঃ সৎ উদ্দেশ্যে কোন কর্ম বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা আমার ও অন্যের মঙ্গলদায়ক মনে না হতে পারে। আবার কখনো কখনো আমার সৎ উদ্দেশ্যে কৃত কর্ম আমার জন্য মঙ্গলদায়ক হলো, কিন্ত অন্যের জন্য কষ্টদায়ক মনে হতে পারে। তবে মিথ্যশ্রয়ী কর্ম সম্পদনের ফল, আমার এবং অন্যের জন্য অবশ্যই কষ্টদায়ক হবে। কুশলধর্মী কর্মের ফল আমার এবং অন্যের জন্য সর্বাঙ্গীন মঙ্গলদায়ক হবে। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মের ফলপ্রাপ্তি শুধু সময়ের ব্যাপার। বুদ্ধ বিচার বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সত্যাশ্রয়ী ও মিথ্যাশ্রয়ী কর্ম সম্পাদনের এবং কর্মফল প্রাপ্তির ব্যাখ্যা করেছেন। প্রকৃতির নিয়ম রাজ্যে কার্যকারণ প্রক্রিয়ার এমন বিধান কার্যকরী, যার প্রভাবেই যথাযথ কর্মের যথাযথ ফলের সৃষ্টি হয়। এটিই বুদ্ধের দীর্ঘ ৬বছর কঠোর সাধনালদ্ধ এবং অভিজ্ঞতালদ্ধ সত্যোৎঘাটন।
...............................................
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন