অনূবাদকঃ- অধ্যাপক ডাঃ অরবিন্দ বড়ুয়া
বৌদ্ধ দর্শনের নির্যাস
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধ দর্শনের মূল বক্তব্য কি?
উত্তরঃ বৌদ্ধদর্শনের মূল বক্তব্য "চতুরার্য সত্যে" বিধৃত। একটি চাকার চারপাশের বেড থেকে যেমন তার বাহুগুলি চাকার কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হয়, তেমনি বৌদ্ধদর্শনের সকল বিষয়ের মূল বক্তব্য "চতুরার্য সত্যে" কেন্দ্রীভূত। শব্দটির "চতু" আর্যসত্যের চার; "আর্য" পরিশীলিত জ্ঞান, আর সত্য হলো জীবনমূখী বাস্তবতা। যিনি "চতুরার্যসত্য" হ্রদয়ঙ্গম করেছেন, তিনি জীবন জগতের স্বরুপ প্রণিধান করে জ্ঞানের মহিমায় মহিমান্বিত হয়েছেন।
প্রশ্নঃ- চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য কি?
উত্তরঃ- প্রথম আর্য সত্য হলো সারা জীবন দুঃখ ভোগ করে যেতে হয়। অর্থাৎ বেঁচে থাকতে হলে দৃঃখ ভোগ না করে উপায় নেই; কোন না কোন রকম দুঃখ ছাড়া বেঁছে থাকা সম্ভব নয়। আমাদের সবাইকে অসুস্থতা, শারিরীক আঘাত, ক্লান্তি, বার্ধক্য-যন্ত্রণা, একাকীত্ব, হতাশা, ভীতি, অস্বস্থি, অসন্তোষ, ক্রোধের মত মানসিক ক্লেশ এবং অবশেষে মৃত্যুযন্ত্রণার দুঃখ ভোগ করে যেতে হয়। জীবনজগতে প্রিয়বিয়োগ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ এড়ানো সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধদর্শনের মূল বক্তব্য কি হতাশাবাদী নয়?
উত্তরঃ- হতাশাবাদের আভিধানিক অর্থ হলো- যাই ঘটে, সবই মন্দ, ভাল কিছুই ঘটে না, মন্দ ব্যক্তি ভাল ব্যক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী ইত্যাদি। এর কোনটিতে বৌদ্ধদর্শন বিশ্বাসী নয়। তাছাড়া সুখশান্তি নেই, এই কথায়ও বৌদ্ধদর্শন বিশ্বাসী নয়। বৌদ্ধদর্শনের বক্তব্য হলো, বেঁচে থাকতে হলে জীবনে অপরিহার্য দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে যেতে হবে যা কারও অস্বীকার করার উপায় নেই। অলৌকিক পৌরনিক কল্পকাহিনীর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধর্মের যে মূলবক্তব্য, তা বাস্তব অভিজ্ঞতার যুক্তি দিয়ে মেনে নেয়া দুষ্কর। বৌদ্ধদর্শনের মূলবক্তব্য বাস্তব অভিজ্ঞতা লদ্ধ। বাস্তব সত্য এই যে, আমরা সবাই জাগতিক দুঃখ যন্ত্রণা ভোগকরি যা হগতে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আমরা অহরহ সংগ্রাম করে যাচ্ছি। বৌদ্ধদর্শনের মানুষের সেই সার্বজনীন চিরন্তন ও দুঃখমুক্তির কথা বলা হয়েছে। এই কারণেই বৌদ্ধধর্মকে সার্বজনীন ও বিশ্ব ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। নিজের মধ্যে সুপ্ত আত্মশক্তিকে জাগ্রত করে জ্ঞানের আলোকে দুঃখ মুক্ত হয়ে নিজেকে সার্বজনীন মঙ্গল কাজে লিপ্ত হতে বৌদ্ধদর্শন শিক্ষা দেয়। বৌদ্ধিক জীবনাদর্শনে হতাশা নেই।
প্রশ্নঃ-দ্বিতীয় আর্যসত্য কি?
উত্তরঃ- দ্বিতীয় আর্যসত্য হলো - "অনিয়মতান্ত্রিক লাগামহীন চাহীদা দুখের সৃষ্টি করে। আমাদের মানসিক যন্ত্রণার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না , কিভাবে দুঃখের সৃষ্টি হয়। যখন আমরা কিছু পেতে চাই , পাইনা, তখন হতাশাগ্রস্ত হই। কোন প্রিয়ব্যক্তিকে আমাদের আশানুরুপ বয়স পর্যন্ত বাচিয়েঁ রাখতে চাই, কিন্তু পারি না, তখন আবার উৎকণ্ঠায় ভেঙ্গে পড়ি। আমরা চাই , অন্যেরা আমাদের স্ম্ন করুক, পছন্দ করুক, যখন তা হয় না তখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তাছাড়া যা চাই তা পেলেও সম্পূর্ণ সুখী হওয়া যায়না। কারণ কিছুদিন পর প্রাপ্ত বস্তুর প্রতি আগ্রহ হ্রাস পায়। এরপর অন্য কিছু পেতে ইচ্ছে জাগে।দ্বিতী সত্যের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে, নিয়ন্ত্রণহীন, লাগামহীন চাহিদা আমাদের প্রকৃত সুখশান্তি দিতে পারে না। অবিরাম আরও চাই , এর চাহিদা মেটে না। প্রয়োজন মেটানোর সন্তুষ্টি সীমাবদ্ধ রাখার মধ্যেই প্রকৃত শন্তি নিহিত।
প্রশ্নঃ-অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা ও অভাববোধ কি ভাবে শারিরীক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে?
উত্তরঃ- সারাজীবন ব্যাপী এটি, সেটি না পাওয়ায় অনিয়ন্ত্রিত তৃঞ্চাবোধ, বৈষয়িক সুখ বিলাস নিয়ে অব্যাহত বেঁচে থাকার কামনার ফলে ব্যক্তি সত্ত্বার মধ্যে এমন ভব উপাদান শক্তি উদ্ভূত হয়, যার প্রভাবে পুনর্জন্ম হয়। এভাবে পুনর্বার দেহধারণের ফলে পুনরায় অপরিহার্য শারিরীক আঘাত, ক্লান্তি, রোগযন্ত্রণা এবং মৃত্যুর শিকারে পরিণত হবার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।
প্রশ্নঃ- সকল প্রকারের চাওয়া পাওয়ার ইচ্ছা বন্ধ করে দিলে তো আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব না, তাই নয় কি?
উত্তরঃ এর উত্তরে বুদ্ধ বলেছেন, তার সারমর্ম হলো, যেহেতু আমাদের অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা না পাওয়ার অসন্তোষ আমাদের কষ্ট দেয় সেহেতু একে রোধ করা উচিত। তিনি আমাদের চাহিদা এবং প্রয়োজনের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, আমাদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব; কিন্তু চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। কারণ চাহিদা তলা বিহীন পাত্রের মতো কখনো পূর্ণ হবার নয়।আমাদের সংসারে কিছু কিছু মৌলিক অপরিহার্য প্রয়োজন আছে; তার জন্য অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে।কিন্তু এর বাইরে যেটি কখনো তৃপ্ত না হবার চাহিদা, তার নিয়ন্ত্রণ অবশ্য করনীয়। প্রকৃতপক্ষে জীবনের উদ্দেশ্য শুধু চাহিদা মেটানোর জন্যে অবিরাম ছুটতে থাকা নয়। জীবনের উদ্দেশ্য প্রকৃত সুখ শান্তি প্রাপ্তির অনুশীলন করা। মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মানুষের কল্যাণধর্মী শিল্প,সাহিত্য বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র নির্মাণ করা।
প্রশ্নঃ- আপনি এর আগে পুনর্জন্মের কথা উল্লেখ করেছেন, পুনর্জন্মের কোনও প্রমাণ আছে কি?
উত্তরঃ পুনর্জন্ম হয়, এ সম্পর্কে প্রচুর প্রমাণ আছে। আমরা পরবর্তী পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করবো।
প্রশ্নঃ তৃতীয় আর্যসত্য কি?
উত্তরঃ তৃতীয় আর্যসত্য হলো, "দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়ে প্রকৃত সুখশান্তি লাভ করা যায়"। চতুরার্য সত্যে এটিই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এখানে বুদ্ধ আমাদের সুখশান্তি পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। আমরা যখন অর্থহীন লাগামহীন চাহিদা বর্জন করি, সংসারের অপরিহার্য বাস্তবতাকে ধৈর্য ও অধ্যাবসায়ে ও ক্রোধহীন হয়ে সমাধান করে অন্যের প্রতি ঘৃণাবোধ রোধ করি, বর্তমানের প্রতিদিনটিতে অভিজ্ঞতা লদ্ধ আনন্দে বাঁচার সন্তুষ্টি নিয়ে বাঁচতে শিখি, এইভাবে মৃত অতীতের জন্য অনুশোচনা না করে, বরং অতীতের কৃত ভূল থেকে শিক্ষা লাভ করে, অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে দুঃচিন্তা না করে, সম্পূর্ণভাবে বর্তমানের প্রতি মুহুর্তের মধ্যে বাঁচার অনুশীলন করে বর্তমাণকে কুশল করে, ভবিষ্যতকে মনোরম করে গড়া যায়। আমরা এভাবে দুঃখকে অতিক্রম করে প্রকৃত সুখশান্তি লাভ করতে পারি।এই অবস্থায় আমরা নিজের গন্ডিবদ্ধ সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা মুক্ত হয়ে অন্যকে সাহায্য করার সহমর্মিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি। এ অবস্থার ক্রম-অগ্রগতির ফলে মানসিক সকল প্রকার যন্ত্রণার উপশম হয় এবং নির্বাণের পথ সুগম হয়।
প্রশ্নঃ- নির্বাণ কি? এর অবস্থান কোথায়?
উত্তরঃ নির্বাণ স্থান-কাল-মাত্রা উত্তীর্ণ এক অবস্থা। স্থান-কাল-মাত্রা সীমিত কোন বিষয় বর্ণণা করা যেতে পারে, কিন্তু স্থান- কাল-মাত্রা উত্তীর্ণ বিষয়ের বর্ণণা করা সম্ভব নয়। এর ব্যখ্যা , নির্বাণে উত্তীর্ণ নয়, এমন কারও পক্ষে বর্ণনা ও উপলদ্ধি করা সম্ভব নয়। নির্বাণ অনন্ত যার কোন পরিসীমা নেই, আত্ম-অনাত্ম নেই। বুদ্ধ বলেছেন, নির্বাণ নিজ অভিজ্ঞতালদ্ধ অনুভূতির বিষয়, বর্ণনায় এর যথার্থতা বুঝানো সম্ভব নয়। গুড়, চিনি, মধূ কোনটির মিষ্টি কিরুপ, তা যেমন স্বাদ গ্রহণ করে অনুভব করতে হয়, নির্বাণ বিষয়টিও অনুরুপ। বুদ্ধ বলেছেন, নির্বাণ হলো এক অপরিমেয় সুখানুভূতি।এখানে জন্ম-মৃত্যু ও দুঃখের যন্ত্রণা নেই, তথা প্রচলিত সুখের বিহ্বলতাও নেই। এটি সুখ-দুঃখ উত্তীর্ণ, নির্বাণ প্রশান্ত অবস্থা।
প্রশ্নঃ- নির্বান এক মাত্রা উত্তীর্ণ অবস্থা, তার কি কোন প্রমাণ আছে?
উত্তরঃ না তার কোন প্রমাণ নেই বটে; কিন্তু এ সম্পর্কে মন্তব্য করা যায়। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় মাত্রাসীমিত সময় ও স্থানের অস্তিত্ব থাকাতে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মাত্রা উত্তীর্ণ সময় ও স্থানের অস্থিত্ব আছে। এই অবস্থাকে নির্বাণ আখ্যায়িত করা হয়। নিজ অভিজ্ঞতায় নিজের জিহ্বার সাহায্যে আস্বাদিত মিষ্টির স্বাদ যেমন বর্ণনা করা সম্ভব নয়, নির্বাণের সুখ অনুভূতি ও অস্তিত্ব সম্পর্কে তেমনি সরাসরি প্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব না হলেও নির্বাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে বুদ্ধের নিজ অভিজ্ঞতার কথা আছেঃ
"যেখানে না-সৃষ্টি, না-জন্ম, না-বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এবং না-যুক্ত হওয়া প্রক্রিয়া অনুপস্থিত, সেখানে সৃষ্টি হওয়া, জন্ম হওয়া, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া, যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে যেখানে সৃষ্টি, জন্ম, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও যুক্ত হবার প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব বিদ্যমান, সেখানে সৃষ্টি, জন্ম, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও যুক্ত হবার প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব বিদ্যমান বলে সিদ্ধান্ত নেয়া বিজ্ঞান সম্মত"। নির্বাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে উপরোক্ত ব্যাখ্যায় দেখি, প্রকৃতপক্ষে নির্বাণ স্তরে উন্নিত হলেই নির্বাণ সম্বন্ধে জানা সম্ভব হয়। তার আগে আমাদের ঐ অনাবিল, অপ্রমেয় শান্তি স্তরে নিজেদের উন্নিত করার অনুশীলনে মগ্ন হওয়া কর্তব্য।
প্রশ্নঃ- চতুরার্য সত্যের চতুর্থ আর্যসত্য কি?
উত্তরঃ চতুর্থ সত্যে দুঃখ দুর করার উপায় উল্লেখ আছে। এই উপায়কে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। এই আট অঙ্গ হলোঃ
১) সম্যকভাবে বুঝা বা হৃদয়াঙ্গম করা।সম্যকদৃষ্টিতে যা যেমন তাকে তেমনভাবে প্রত্যক্ষ করা।
২) সম্যক কর্ম হল, সঠিক ভাবে কর্ম সম্পাদন করার সঙ্কল্প গ্রহণ করা।
৩) সম্যক বাক্য হল যা নিজের ও অন্যর জন্য ক্ষতিকর নয়, এমন বাক্যালাপ।
৪) নিজের এবং অন্যের জন্য কুশলধর্মী কর্ম সম্পাদন করা।
৫) সম্যকভাবে জীবীকা অর্জন কর (মাদক দব্য, বিষ, মাছ-মাংস, মারণাস্ত্র, দেহব্যাবসা ইত্যাদি অসম্যক জীবীকা)।
৬) সম্যক চেষ্টা করা।
৭) সম্যক স্মৃতিহল, যখন যা করা হয় তখন তাতে সচেতন মনোযোগ রাখা।
৮) সম্যক সমাধি হল, জীবনাচরণে মনের একাগ্রতা।
বৌদ্ধ জীবনাচরণে এই আটটি জীবনাচরণ সম্পূর্ণতা লাভ না করা পর্যন্ত সাধনা ও প্রয়াস অব্যহত রাখা। বিশ্লেষণও বিচার করলে লক্ষ্য করা যায়, আর্যঅষ্টাঙ্গীক মার্গের ৮টি জীবনাচরণের মধ্যে জীবনের প্রয়োজনীয় প্রত্যকবিষয়, বুদ্ধিবৃত্তি, মেধা,নৈতিকতা, সমাজত্ত্ব, অর্থনীতি, মনস্ত্ব- এক কথায় একজন মানুষের পার্থিব জীবন থেকে আধ্যাত্ম জীবনে উন্নয়নের সকল বিধি বিধৃত আছে।
........................
বৌদ্ধ দর্শনের নির্যাস
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধ দর্শনের মূল বক্তব্য কি?
উত্তরঃ বৌদ্ধদর্শনের মূল বক্তব্য "চতুরার্য সত্যে" বিধৃত। একটি চাকার চারপাশের বেড থেকে যেমন তার বাহুগুলি চাকার কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হয়, তেমনি বৌদ্ধদর্শনের সকল বিষয়ের মূল বক্তব্য "চতুরার্য সত্যে" কেন্দ্রীভূত। শব্দটির "চতু" আর্যসত্যের চার; "আর্য" পরিশীলিত জ্ঞান, আর সত্য হলো জীবনমূখী বাস্তবতা। যিনি "চতুরার্যসত্য" হ্রদয়ঙ্গম করেছেন, তিনি জীবন জগতের স্বরুপ প্রণিধান করে জ্ঞানের মহিমায় মহিমান্বিত হয়েছেন।
প্রশ্নঃ- চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য কি?
উত্তরঃ- প্রথম আর্য সত্য হলো সারা জীবন দুঃখ ভোগ করে যেতে হয়। অর্থাৎ বেঁচে থাকতে হলে দৃঃখ ভোগ না করে উপায় নেই; কোন না কোন রকম দুঃখ ছাড়া বেঁছে থাকা সম্ভব নয়। আমাদের সবাইকে অসুস্থতা, শারিরীক আঘাত, ক্লান্তি, বার্ধক্য-যন্ত্রণা, একাকীত্ব, হতাশা, ভীতি, অস্বস্থি, অসন্তোষ, ক্রোধের মত মানসিক ক্লেশ এবং অবশেষে মৃত্যুযন্ত্রণার দুঃখ ভোগ করে যেতে হয়। জীবনজগতে প্রিয়বিয়োগ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ এড়ানো সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধদর্শনের মূল বক্তব্য কি হতাশাবাদী নয়?
উত্তরঃ- হতাশাবাদের আভিধানিক অর্থ হলো- যাই ঘটে, সবই মন্দ, ভাল কিছুই ঘটে না, মন্দ ব্যক্তি ভাল ব্যক্তি অপেক্ষা শক্তিশালী ইত্যাদি। এর কোনটিতে বৌদ্ধদর্শন বিশ্বাসী নয়। তাছাড়া সুখশান্তি নেই, এই কথায়ও বৌদ্ধদর্শন বিশ্বাসী নয়। বৌদ্ধদর্শনের বক্তব্য হলো, বেঁচে থাকতে হলে জীবনে অপরিহার্য দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে যেতে হবে যা কারও অস্বীকার করার উপায় নেই। অলৌকিক পৌরনিক কল্পকাহিনীর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধর্মের যে মূলবক্তব্য, তা বাস্তব অভিজ্ঞতার যুক্তি দিয়ে মেনে নেয়া দুষ্কর। বৌদ্ধদর্শনের মূলবক্তব্য বাস্তব অভিজ্ঞতা লদ্ধ। বাস্তব সত্য এই যে, আমরা সবাই জাগতিক দুঃখ যন্ত্রণা ভোগকরি যা হগতে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আমরা অহরহ সংগ্রাম করে যাচ্ছি। বৌদ্ধদর্শনের মানুষের সেই সার্বজনীন চিরন্তন ও দুঃখমুক্তির কথা বলা হয়েছে। এই কারণেই বৌদ্ধধর্মকে সার্বজনীন ও বিশ্ব ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। নিজের মধ্যে সুপ্ত আত্মশক্তিকে জাগ্রত করে জ্ঞানের আলোকে দুঃখ মুক্ত হয়ে নিজেকে সার্বজনীন মঙ্গল কাজে লিপ্ত হতে বৌদ্ধদর্শন শিক্ষা দেয়। বৌদ্ধিক জীবনাদর্শনে হতাশা নেই।
প্রশ্নঃ-দ্বিতীয় আর্যসত্য কি?
উত্তরঃ- দ্বিতীয় আর্যসত্য হলো - "অনিয়মতান্ত্রিক লাগামহীন চাহীদা দুখের সৃষ্টি করে। আমাদের মানসিক যন্ত্রণার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না , কিভাবে দুঃখের সৃষ্টি হয়। যখন আমরা কিছু পেতে চাই , পাইনা, তখন হতাশাগ্রস্ত হই। কোন প্রিয়ব্যক্তিকে আমাদের আশানুরুপ বয়স পর্যন্ত বাচিয়েঁ রাখতে চাই, কিন্তু পারি না, তখন আবার উৎকণ্ঠায় ভেঙ্গে পড়ি। আমরা চাই , অন্যেরা আমাদের স্ম্ন করুক, পছন্দ করুক, যখন তা হয় না তখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তাছাড়া যা চাই তা পেলেও সম্পূর্ণ সুখী হওয়া যায়না। কারণ কিছুদিন পর প্রাপ্ত বস্তুর প্রতি আগ্রহ হ্রাস পায়। এরপর অন্য কিছু পেতে ইচ্ছে জাগে।দ্বিতী সত্যের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে, নিয়ন্ত্রণহীন, লাগামহীন চাহিদা আমাদের প্রকৃত সুখশান্তি দিতে পারে না। অবিরাম আরও চাই , এর চাহিদা মেটে না। প্রয়োজন মেটানোর সন্তুষ্টি সীমাবদ্ধ রাখার মধ্যেই প্রকৃত শন্তি নিহিত।
প্রশ্নঃ-অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা ও অভাববোধ কি ভাবে শারিরীক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে?
উত্তরঃ- সারাজীবন ব্যাপী এটি, সেটি না পাওয়ায় অনিয়ন্ত্রিত তৃঞ্চাবোধ, বৈষয়িক সুখ বিলাস নিয়ে অব্যাহত বেঁচে থাকার কামনার ফলে ব্যক্তি সত্ত্বার মধ্যে এমন ভব উপাদান শক্তি উদ্ভূত হয়, যার প্রভাবে পুনর্জন্ম হয়। এভাবে পুনর্বার দেহধারণের ফলে পুনরায় অপরিহার্য শারিরীক আঘাত, ক্লান্তি, রোগযন্ত্রণা এবং মৃত্যুর শিকারে পরিণত হবার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।
প্রশ্নঃ- সকল প্রকারের চাওয়া পাওয়ার ইচ্ছা বন্ধ করে দিলে তো আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব না, তাই নয় কি?
উত্তরঃ এর উত্তরে বুদ্ধ বলেছেন, তার সারমর্ম হলো, যেহেতু আমাদের অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা না পাওয়ার অসন্তোষ আমাদের কষ্ট দেয় সেহেতু একে রোধ করা উচিত। তিনি আমাদের চাহিদা এবং প্রয়োজনের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, আমাদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব; কিন্তু চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। কারণ চাহিদা তলা বিহীন পাত্রের মতো কখনো পূর্ণ হবার নয়।আমাদের সংসারে কিছু কিছু মৌলিক অপরিহার্য প্রয়োজন আছে; তার জন্য অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে।কিন্তু এর বাইরে যেটি কখনো তৃপ্ত না হবার চাহিদা, তার নিয়ন্ত্রণ অবশ্য করনীয়। প্রকৃতপক্ষে জীবনের উদ্দেশ্য শুধু চাহিদা মেটানোর জন্যে অবিরাম ছুটতে থাকা নয়। জীবনের উদ্দেশ্য প্রকৃত সুখ শান্তি প্রাপ্তির অনুশীলন করা। মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মানুষের কল্যাণধর্মী শিল্প,সাহিত্য বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র নির্মাণ করা।
প্রশ্নঃ- আপনি এর আগে পুনর্জন্মের কথা উল্লেখ করেছেন, পুনর্জন্মের কোনও প্রমাণ আছে কি?
উত্তরঃ পুনর্জন্ম হয়, এ সম্পর্কে প্রচুর প্রমাণ আছে। আমরা পরবর্তী পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করবো।
প্রশ্নঃ তৃতীয় আর্যসত্য কি?
উত্তরঃ তৃতীয় আর্যসত্য হলো, "দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়ে প্রকৃত সুখশান্তি লাভ করা যায়"। চতুরার্য সত্যে এটিই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এখানে বুদ্ধ আমাদের সুখশান্তি পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। আমরা যখন অর্থহীন লাগামহীন চাহিদা বর্জন করি, সংসারের অপরিহার্য বাস্তবতাকে ধৈর্য ও অধ্যাবসায়ে ও ক্রোধহীন হয়ে সমাধান করে অন্যের প্রতি ঘৃণাবোধ রোধ করি, বর্তমানের প্রতিদিনটিতে অভিজ্ঞতা লদ্ধ আনন্দে বাঁচার সন্তুষ্টি নিয়ে বাঁচতে শিখি, এইভাবে মৃত অতীতের জন্য অনুশোচনা না করে, বরং অতীতের কৃত ভূল থেকে শিক্ষা লাভ করে, অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে দুঃচিন্তা না করে, সম্পূর্ণভাবে বর্তমানের প্রতি মুহুর্তের মধ্যে বাঁচার অনুশীলন করে বর্তমাণকে কুশল করে, ভবিষ্যতকে মনোরম করে গড়া যায়। আমরা এভাবে দুঃখকে অতিক্রম করে প্রকৃত সুখশান্তি লাভ করতে পারি।এই অবস্থায় আমরা নিজের গন্ডিবদ্ধ সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা মুক্ত হয়ে অন্যকে সাহায্য করার সহমর্মিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি। এ অবস্থার ক্রম-অগ্রগতির ফলে মানসিক সকল প্রকার যন্ত্রণার উপশম হয় এবং নির্বাণের পথ সুগম হয়।
প্রশ্নঃ- নির্বাণ কি? এর অবস্থান কোথায়?
উত্তরঃ নির্বাণ স্থান-কাল-মাত্রা উত্তীর্ণ এক অবস্থা। স্থান-কাল-মাত্রা সীমিত কোন বিষয় বর্ণণা করা যেতে পারে, কিন্তু স্থান- কাল-মাত্রা উত্তীর্ণ বিষয়ের বর্ণণা করা সম্ভব নয়। এর ব্যখ্যা , নির্বাণে উত্তীর্ণ নয়, এমন কারও পক্ষে বর্ণনা ও উপলদ্ধি করা সম্ভব নয়। নির্বাণ অনন্ত যার কোন পরিসীমা নেই, আত্ম-অনাত্ম নেই। বুদ্ধ বলেছেন, নির্বাণ নিজ অভিজ্ঞতালদ্ধ অনুভূতির বিষয়, বর্ণনায় এর যথার্থতা বুঝানো সম্ভব নয়। গুড়, চিনি, মধূ কোনটির মিষ্টি কিরুপ, তা যেমন স্বাদ গ্রহণ করে অনুভব করতে হয়, নির্বাণ বিষয়টিও অনুরুপ। বুদ্ধ বলেছেন, নির্বাণ হলো এক অপরিমেয় সুখানুভূতি।এখানে জন্ম-মৃত্যু ও দুঃখের যন্ত্রণা নেই, তথা প্রচলিত সুখের বিহ্বলতাও নেই। এটি সুখ-দুঃখ উত্তীর্ণ, নির্বাণ প্রশান্ত অবস্থা।
প্রশ্নঃ- নির্বান এক মাত্রা উত্তীর্ণ অবস্থা, তার কি কোন প্রমাণ আছে?
উত্তরঃ না তার কোন প্রমাণ নেই বটে; কিন্তু এ সম্পর্কে মন্তব্য করা যায়। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় মাত্রাসীমিত সময় ও স্থানের অস্তিত্ব থাকাতে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মাত্রা উত্তীর্ণ সময় ও স্থানের অস্থিত্ব আছে। এই অবস্থাকে নির্বাণ আখ্যায়িত করা হয়। নিজ অভিজ্ঞতায় নিজের জিহ্বার সাহায্যে আস্বাদিত মিষ্টির স্বাদ যেমন বর্ণনা করা সম্ভব নয়, নির্বাণের সুখ অনুভূতি ও অস্তিত্ব সম্পর্কে তেমনি সরাসরি প্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব না হলেও নির্বাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে বুদ্ধের নিজ অভিজ্ঞতার কথা আছেঃ
"যেখানে না-সৃষ্টি, না-জন্ম, না-বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এবং না-যুক্ত হওয়া প্রক্রিয়া অনুপস্থিত, সেখানে সৃষ্টি হওয়া, জন্ম হওয়া, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া, যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে যেখানে সৃষ্টি, জন্ম, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও যুক্ত হবার প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব বিদ্যমান, সেখানে সৃষ্টি, জন্ম, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও যুক্ত হবার প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব বিদ্যমান বলে সিদ্ধান্ত নেয়া বিজ্ঞান সম্মত"। নির্বাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে উপরোক্ত ব্যাখ্যায় দেখি, প্রকৃতপক্ষে নির্বাণ স্তরে উন্নিত হলেই নির্বাণ সম্বন্ধে জানা সম্ভব হয়। তার আগে আমাদের ঐ অনাবিল, অপ্রমেয় শান্তি স্তরে নিজেদের উন্নিত করার অনুশীলনে মগ্ন হওয়া কর্তব্য।
প্রশ্নঃ- চতুরার্য সত্যের চতুর্থ আর্যসত্য কি?
উত্তরঃ চতুর্থ সত্যে দুঃখ দুর করার উপায় উল্লেখ আছে। এই উপায়কে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। এই আট অঙ্গ হলোঃ
১) সম্যকভাবে বুঝা বা হৃদয়াঙ্গম করা।সম্যকদৃষ্টিতে যা যেমন তাকে তেমনভাবে প্রত্যক্ষ করা।
২) সম্যক কর্ম হল, সঠিক ভাবে কর্ম সম্পাদন করার সঙ্কল্প গ্রহণ করা।
৩) সম্যক বাক্য হল যা নিজের ও অন্যর জন্য ক্ষতিকর নয়, এমন বাক্যালাপ।
৪) নিজের এবং অন্যের জন্য কুশলধর্মী কর্ম সম্পাদন করা।
৫) সম্যকভাবে জীবীকা অর্জন কর (মাদক দব্য, বিষ, মাছ-মাংস, মারণাস্ত্র, দেহব্যাবসা ইত্যাদি অসম্যক জীবীকা)।
৬) সম্যক চেষ্টা করা।
৭) সম্যক স্মৃতিহল, যখন যা করা হয় তখন তাতে সচেতন মনোযোগ রাখা।
৮) সম্যক সমাধি হল, জীবনাচরণে মনের একাগ্রতা।
বৌদ্ধ জীবনাচরণে এই আটটি জীবনাচরণ সম্পূর্ণতা লাভ না করা পর্যন্ত সাধনা ও প্রয়াস অব্যহত রাখা। বিশ্লেষণও বিচার করলে লক্ষ্য করা যায়, আর্যঅষ্টাঙ্গীক মার্গের ৮টি জীবনাচরণের মধ্যে জীবনের প্রয়োজনীয় প্রত্যকবিষয়, বুদ্ধিবৃত্তি, মেধা,নৈতিকতা, সমাজত্ত্ব, অর্থনীতি, মনস্ত্ব- এক কথায় একজন মানুষের পার্থিব জীবন থেকে আধ্যাত্ম জীবনে উন্নয়নের সকল বিধি বিধৃত আছে।
........................
Thanks for the nice blog on Buddhist philosoph. Great resource.Dhonnobad. :)
উত্তরমুছুন@WebDesign. Thank You very much for your appreciation.
উত্তরমুছুন