কুশল প্রশ্নোত্তর - ভদন্ত এস. ধাম্মিকা

কুশল প্রশ্নোত্তর
ভদন্ত এস. ধাম্মিকা
অনূবাদকঃ- অধ্যাপক ডাঃ  অরবিন্দ বড়ুয়া 

প্রথম প্রকাশ
মে, ২০০৪ সাল, ২৫৪৮ বুদ্ধাব্দ

দ্বিতীয় প্রকাশ                   
৮ জানুয়ারী, ২০০৬ সাল           
শ্রদ্ধাদানঃ- ৩০.০০টাকা
.........................................................

নিবেদন
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বৌদ্ধ দর্শন বিষয়ে বিদগ্ধ লেখকের প্রবন্ধ অবলম্বনে, ভদন্ত শ্রাবস্তী ধাম্মিকা মহোদয় প্রণীত, গুড কোয়েশ্শন গুড আনসারস বইটির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা মেটাতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বুড্ডিস্ট এসোসিয়েশন, ইউনাইটেড স্টেট এর সহায়তায় সম্প্রতি বইটির ইংরেজী সংকলন আমেরিকার পাঠকগণের কাছে সহজলভ্য হয়েছে। নিউয়র্ক বুড্ডিস্ট বিহার লাইব্রেরীর সৌজন্যে পাওয়া এই বই এর ইংরেজী সংকলনটি পাঠ করে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য বইটি বাংলায় অনূবাদ করতে আগ্রহী হই। মূলগ্রন্থে আলোচিত বিষয়কে সহজবোধ্য এবং ব্যাখ্যা করার জন্য অনূবাদের সময় শব্দানূবাদের চেয়ে ভাবানূবাদের দিকে সমধিক গুরূত্ব দিয়েছি। বইটি পাঠ করে আমি আশাকরি পাঠক জীবনমূখী বিভিন্ন প্রশ্নের মনোরম উত্তর খূজেঁ পেয়ে শংশয়মুক্ত হবার আনন্দ উপভোগ করবেন।
পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।
অধ্যাপক অরবিন্দ বড়ুয়া

বৌদ্ধধর্ম
প্রশ্নঃ-বৌদ্ধধর্ম কি?
উত্তরঃ বৌদ্ধ শব্দটি বোধ শব্দ থেকে উদ্ভূত। বোধি বলতে জাগ্রত হওয়া বুঝায় তাই, বৌদ্ধধর্ম জাগ্রত হবার দর্শন। মানবপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম ৩৫ বছর বয়সে ব্যক্তিগত সাধনালদ্ধ অভিজ্ঞতা দর্শনে জাগ্রত হয়েছিলেন। এই ঘটনা আজ থেকে ২৫৪৮ বছর আগের। বর্তমানে সারা বিশ্বে অসংখ্য মানুষ এই দর্শনের অনূসারী। একশত বছর আগে এই ধর্ম শুধুমাত্র এশিয়া মহাদেশে সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রশ্নঃ-বৌদ্ধধর্ম কি তাত্ত্বিক দশর্ন?
উত্তরঃ দর্শনের প্রতিশব্দ ফিলজপি শব্দটি ফিলো এবং সোপিয়া এই দুটি ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে। ফিলো শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা এবং সোপিয়া অর্থ প্রজ্ঞা। ফিলোজপি বলতে বুঝায় প্রজ্ঞা উদ্ভূত ভালোবাসা। প্রকৃতপক্ষে এটিই বৌদ্ধধর্মের শূল বাণী। বৌদ্ধধর্ম মানুষের বুদ্ধি ও মেধাশক্তি বিকশিত করে জীবনের স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করে। এতে আমরা সকল জীবের প্রতি মৈতী-করূণায় উদ্ভূত হই। তাই বৌদ্ধধর্ম শুধূমাত্র তাত্ত্বিক দর্শন নয় বরং জীবনমূখী বাস্তব দর্শন
প্রশ্নঃ-বুদ্ধ কে ছিলেন?
উত্তরঃ ৬২৪ খ্রীষ্ট পূবে ভারতের এক রাজপরিবারের এক শিশুর জন্ম হয়। রাজ ঐশ্বয্য ও বিলাসে লালিত হলেও কালক্রমে তাঁরএই উপলদ্ধি হয় যে, রাজ ঐশ্বর্য প্রকৃত সুখ শান্তি দিতে পারে না। চারপাশের মানুষের নানা দুঃখ যন্ত্রনা দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। জীবের দুঃখ ও দুঃখের কারণ থেকে মুক্তির উপায় উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে ২৯ বছর বয়সে স্ত্রী-পুত্র, মা-বাবা, রাজ ঐশ্বয্যের বিলাস বহুল জীবন ত্যাগ করে অনিশ্চিত জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে তিনি সংসার ত্যাগ করেন। তকালীন মুনী্ ঋষিদের কাছে দুঃখমুক্তির সঠিক সমাধান না পেয়ে অবশেষে তিনি নিজেই সমাধান উদঘাটনের জন্য কঠোর সাধনায় মগ্ন হন। দীর্ঘ ৬ বছরের কঠোর সাধনার পর আপন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জীবনের স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞাত হন। অজ্ঞতা দূর করে জ্ঞান উপলদ্ধি করেন বলে তিনি বুদ্ধ রুপে আখ্যায়িত হন। এরপর মহাপ্রয়ান পযর্ন্ত ৪৫ বছর ধরে সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করে তাঁর লদ্ধ জ্ঞান প্রচার করেন। তাঁর চরিত্রের অনাবিল ধৈয্য, মৈত্রী, করূণার মহিমায় তিনি সকলের কাছে মহিমান্বিত হয়ে উঠেন। পরিশেষে ৮০ বছর বয়সে জীবন জগতের অপ্রতিরোধ্য বাধর্ক্য ও রোগে আক্রান্ত হলেও পরম সুখশান্তি নিয়ে দেহত্যাগ করেন।
প্রশ্নঃ- আপন স্ত্রী-পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ না করে সংসার ত্যাগ করা দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় নয় কি?
উত্তরঃ তাঁর পক্ষে পরিজনদের ছেড়ে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ ছিল না। সংসার ত্যাগের আগে দীর্ঘদিন এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি সংকটে পড়েন। তাঁর কাছে দুটি পথ খোলা ছিল, একদিকে রাজ ঐশ্বয্যের সুখবিলাসে পরিজনের জন্য জীবনযাপন করবেন নাকি বিশ্বের মানুষের কল্যাণের জন্য জীবনয়াপন করবেন? অবশেষে তাঁর করূণাদ্র হৃদয় বিশ্বের মানুষের কল্যাণ ও জীবের দুঃখ মুক্তির জন্য তাকেঁ জীবন উসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর এই আত্মত্যাগ কি দ্বয়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচায়ক হতে পারে? আসলে এটি ছিল ঐতিহাসিক আত্মত্যাগ যার শুভফল এখনও জগতের মানুষ অবিরত লাভ করে যাচ্ছে।
প্রশ্নঃ- বুদ্ধ তো বেঁচে নেই। তিনি কিভাবে আমাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করবেন?
উত্তরঃ পদার্থ বিজ্ঞানী ফ্যারাডে বিদ্যুত শক্তি আবিষ্কার করেন। এখন তিনি বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর আবিষ্কার কি এখনও আমাদের উপকার করে যাচ্ছে না? চিকিসা বিজ্ঞানী লুইস পাস্তুরের আবিষ্কার অদ্যাবধি রোগ নিরাময়ে কাজ করছে, তিনি তো এখন নেই। লিওনার্দো ভিন্সির শিল্পকর্ম তাঁর মৃত্যুর এত দীর্ঘ সময় পরেও মানুষকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে। মনীষীদের মৃত্যু হয়; কিন্তু তাদেঁর অবদান বা কর্মফসল যুগযুগ ধরে আমাদের অনুপ্রাণিত করে দিক নির্দেশনা দেয়। বুদ্ধ এখন জীবিত নেই , কিন্তু তাঁর শিক্ষা, ঝীবনাদর্শ ও উপদেশাবলী আমাদের দুঃখ-দুদর্শা ও সমস্যা উত্তরণের প্রেরণা দিয়ে জীবনধারা বদলে দিচ্ছে। মৃত্যুর পরেও বুদ্ধের মতো মহাপুরুষের কীর্তি শত শত শতাব্দী ধরে এই ক্ষমতা ধারণ করে।

প্রশ্নঃ-বুদ্ধ কি ঈশ্বর ছিলেন?
উত্তরঃ না, বুদ্ধ স্বয়ং ঈশ্বর , ঈশ্বরের প্রেরিত সন্তান কিংবা ঈশ্বরের প্রেরিত দূত ছিলেন না। আমাদের সবার মতো তিনি একজন মানুষ, একজন মানবপুত্র। নিজ কর্মসাধনার অভিজ্ঞতার অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে জগত জীবনের প্রকৃত স্বরুপ জ্ঞাত হয়ে তিনি জ্ঞানের আলোকে প্রজ্ঞাবান হয়েছিলেন। উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করছিলেন, তাঁর উদ্ঘাটিত জ্ঞানের পথে জীবনাচরণ করে যে কোন ব্যক্তি তাঁর মতো বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ করে প্রকৃত সুখ শান্তি লাভ করতে পারেন।

প্রশ্নঃ- বুদ্ধ যদি ঈশ্বর না হন, তাহলে তাঁকে প্রার্থনা করা হয় কেন?
উত্তরঃ বিভিন্ন পদ্ধতির প্রার্থনা আছে। একপ্রকার প্রার্থনা আছে, যেখানে প্রার্থনাকারী তাদেঁর ঈশ্বরের নিকট শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে অভিস্ট পূরণের জন্য প্রার্থনা করেন। এই আশা নিয়ে যে ঈশ্বর তা শুনে পুরণ করবেন। এইরুপ প্রার্থনায় কোন বৌদ্ধ বিশ্বাসী নন। অন্য এক প্রার্থনা পদ্ধতিতে অনুসারীগণ তাদেঁর পূজ্য ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করেন। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় যেইভাবে ছাত্ররা তাঁদের শিক্ষককে দাঁড়িয়ে কিংবা জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত গীতি হবার সময় সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। বৌদ্ধরা এই শেষোক্ত পদ্ধতিতে বুদ্ধকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন।

প্রশ্নঃ-শোনা যায় বৌদ্ধরা পুত্তলিকা পূজা করেন। তা কি সত্য?
উত্তরঃ একথা সত্য নয়। পুত্তলিকা বলতে বুঝায় প্রতিমূতি বানিয়ে ঈশ্বর কিংবা দেব দেবী রুপে পূজা করা। কিন্তু বৌদ্ধরা বুদ্ধকে ঈশ্বর মনে করেন না। তাই ঐ কথা ভুল, সঠিক নয়। সাধারণতঃ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা তাঁদের বিশ্বাসকে কোন প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন। যেমন তাওধর্মে বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হিসেবেব্যবহার করেন ওয়াইন ইয়ং, শিখধর্মে আধ্যাত্মিক সংগ্রামে প্রতীক হিসেবে তলোয়ার এবং খ্রীষ্টধর্মে যীশুর উপস্থিতিকে মাছ হিসেবে, যীশুর আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে ক্রুশচিহ্ন ব্যবহার করে থাকেন। পদ্মাসনে বসা, হাত দুটি আলতোভাবে কোলে রাখা, করুণসিক্ত মৃদু হাসি-মাখা মুখমন্ডলের বুদ্ধমূর্তির প্রতীকটি বৌদ্ধদের হৃদয়ে প্রেম ভালবাসা করুণা মৈত্রী জাগানোর প্রেরণা যোগায়।পূজার্ঘ্য ধূপের সৌরভ সৎগুণাবলীর সুপ্রভার কথা, প্রজ্জলিত মোমবাতির শিখা ঝীবন সম্বন্ধে অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলোকে আলোকিত হবার এবং পূজার খাদ্যদ্রব্যকে প্রসাদ হিসেবে ভোগ না করে ত্যাগের চেতনা গড়ে তোলার এবং সকাল বেলায় অর্পিত ফুলের সৌন্দর্য বিকালে কিভাবে ক্রমশঃ ম্লান হয়ে যায় তার মধ্য দিয়ে যৌবনের দেহকান্তির অনিত্য ও অস্থায়ীত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় বৌদ্ধ পূজারীকে। বুদ্ধের মূর্তির সামনে বৌদ্ধদের প্রণাম নিবেদনের অর্থ, বুদ্ধের যে দুঃখমুক্তির শিক্ষা, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করা হয়। এইসব হলো বৌদ্ধদের প্রার্থনা ও পূজার অন্তঃর্নিহিত উদ্দেশ্য।বুদ্ধের মূর্তিকে বুদ্ধের মানবিকতা লাভের প্রতীক হিসেবে এখানে ব্যবহার করা হয়। প্রত্যক মানুষের মধ্যে অনন্ত শক্তি নিহিত আছে এই শক্তি বিকাশের জন্য বাইরে নয়; অন্তঃর্লোকে দৃষ্টি ফেরাতে হয়। বৌদ্ধদর্শন ঈশ্বর কেন্দ্রিক নয় এটি মানব কেন্দ্রিক, এই বিষয় পূজার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধরা উপলদ্ধি করার চেষ্টা করেন।

প্রশ্নঃ- বৌদ্ধরা বৌদ্ধমন্দিরে কাগজের টাকা পোড়ানো সহ ঐ ধরণের অনুষ্ঠান করেন কেন?
উত্তরঃ কোন বিষয় সম্পর্কে সঠিক না জেনে সেই সম্পর্কে ধারণা করা উচিত নয়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বৌদ্ধদের জীবনাচরণে কিছু কিছু বৌদ্ধদর্শন পরিপন্থী সংস্কার ও বিকৃত বিশ্বাস প্রচলিত আছে। বস্তুতঃ প্রত্যক ধর্মেই িএই ধরণের কিছু কুসংস্কার থাকে। এজন্য শূল ধর্মদর্শনকে দায়ী করা যায় না।এই প্রসঙ্গে বুদ্ধ নিজেই স্পষ্টভাবে বলেছেন।বৌদ্ধদর্শনের ব্যাখ্যা বুঝতে কেউ অক্ষম হয়ে ভুল আচরণ করলে, তজ্জন্য বুদ্ধকে দায়ী করা যায় না। এই প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্যঃ
"চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও রোগী যদি চিকিৎসা না নিয়ে রোগযন্ত্রণা ভোগেন, তার জন্য চিকিৎসক দায়ী নন।" "কেউ যদি বুদ্ধ দেশিত দুঃখমুক্তির উপদেশ যথার্থ আচরণ না করে দুঃখ ভোগ করেন তার জন্য বৌদ্ধ দর্শন দায়ী নয়।" (জাতক নিদান ২৮-৯)কোন ধর্মের অনুসারী যদি নিজ ধর্মের নির্দেশিত জীবনাচরণ অনুশীলন না করে বিপথগামী হয়, তাহলে তা দিয়ে ঐ ধর্মদর্শনের শূল্যায়ন করা উচিত নয়। বৌদ্ধদর্শনকে সম্যকভাবে বুঝতে হলে, বুদ্ধের নির্দেশিত শিক্ষা সম্পকে জানতে হবে, এ বিষয়ে লিখিত গ্রন্থাদি পাঠ করতে হবে, যাঁরা বৌদ্ধ দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞাত তাঁদের সাথে আলোচনা করতে হবে।
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধ জীবনাচরণ কল্যাণকর হলে বৌদ্ধ দেশগুলি দরিদ্র কেন?
উত্তরঃ দরিদ্র বলতে যদি আপনি আর্থিক দারিদ্র্য বুঝেন, তাহলে কিছু বৌদ্ধদেশ দরিদ্র। পক্ষান্তরে দরিদ্র বলতে যদি আপনি জীবন মনের দারিদ্র্য বোঝেন, তাহলে বৌদ্ধদেশ সমৃদ্ধ। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, আমেরিকা অতি ধনী ও শক্তিশালী দেশ, কিন্তু এখান হতে অপরাধমূলক ঘটনার পরিসংখ্যান অধিক। পিতা মাতারা তাদেঁর সন্তানের সেবা বঞ্চিত হয়ে বৃদ্ধ বয়সে একাকীত্বের যন্ত্রনা ভোগ করে বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যুবরণ করে। পারিবারিক সহিংসতা, শিশুনির্যাতন, প্রতি তিনটি দম্পতির মধ্যে একটি করে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা, সহজলভ্য পর্ণোগ্রফি, যৌন অনাচারের নৈতিক অধঃপতন নিয়ে আমেরিকা সমৃদ্ধ। এই দেশের মানুষ অর্থশালী বটে কিন্তু শান্তি বঞ্চিত।বৌদ্ধ দেশ মায়ানমার (বার্মা)প্রসঙ্গে দেখা যাবে, এ দেশের মানুষ আর্থিকভাবে তেমন সমৃদ্ধ নয়; কিন্তু সন্তানেরা মা-বাবাকে সম্মান ও সেবা যত্ন করে। এদেশে অপরাধের পরিসংখ্যান হার কম, বিবাহ বিচ্ছেদ, পারিবারিক সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, আত্মহত্যার ঘটনা নেই বললেই চলে। পর্ণোগ্রফি, যৌন অনাচার কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত। সার্বিক মূল্যায়নে এইদেশ আর্থিকভাবে কিছুটা পশ্চাদপদ হলেও নৈতিক দিক থেকে যে সমৃদ্ধ একথা অনস্বীকার্য। উপরন্তু আর্থিক উন্নয়নের বিচারে জাপান এখন বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ, যেখানে ৯৩ শতাংশ মানুষ নিজেদের বৌদ্ধ বলে পরিচয় দেয়।
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধ কর্তৃক জনহিতকর কর্ম সম্পাদনের কথা তেমন শোনা যায় না কেন?
উত্তরঃ এর প্রধান কারণ হয়তো আত্মপ্রচারণায় বুদ্ধ অনুসারীরা বেশী আগ্রহী নন। কিছুদিন আগে জাপানী বৌদ্ধ নেতা নিক্কো নিওয়ানো ধর্মীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে সৌহার্দ্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় "টেমপ্লেটন" পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছেন। থাই বৌদ্ধ ভিক্ষু মাদকাসক্তি রোধ আন্দোলনে সফলতার স্বীকৃতি স্বরুপ "ম্যাগাসেয়াসে" পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে থাই বৌদ্ধ ভিক্ষু কান্তায়া পিয়াট্ গ্রামাঞ্চলে অনাথ শিশুদের সেবাকাজের জন্য 'নরওয়েযান চিল্ড্রেন পীস্ প্রাইজে" ভূষিত হন। পাশ্চাত্যের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকগণ ভারতের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য মোচনে বহুমূখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রত আছেন। তাঁরা স্কুল, শিশু সংগঠন, দাতব্য চিকিৎসালয়, কুঠিরশিল্প গড়ে তুলেছেন।দুঃখক্লিষ্ট অভাবগ্রস্থদের সেবা-প্রদান বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচারের অন্তঃর্ভূক্ত। এই জন হিতকর কাজগুলি নীরবে নিভৃতে সম্পাদন করাতে তাঁরা বিশ্বাসী। এই কারণে হয়তো বৌদ্ধদের জনহিতকর কার্যকলাপের কথা তেমন শোনা যায় না।
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধ ধর্মমতে এত শ্রেণীবিন্যস কেন?
উত্তরঃ বাজারে নানা প্রকারের চিনি, সাদা চিনি, বাদামী চিনি, দানা চিনি, পাথুরে চিন, তরলচিনি, হিমায়িত চিনি পাওয়া যায়এক কথায় সবই চিনি এবং মিষ্টি বিভিন্নভাবে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন প্রকারের চিনি তৈরী করা হয়েছে ব্যপারটি বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্যএখানে আছে থেরবাদী বৌদ্ধ, জেন্ বৌদ্ধ, যোগচার বৌদ্ধ, বজ্রযান বৌদ্ধ প্রভৃতিকিন্তু সবার মধ্যে এক অভিন্ন আদর্শবাদ বিদ্যমানবিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন সংষ্কৃতির সংগে সহবস্থানের প্রয়োজনে বৌদ্ধধর্ম বিভিন্ন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থে আত্মপ্রকাশ করেছেমাঝে মাঝে যুগের পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার প্রয়োজনে এর পুনর্মূল্যায়নও করা হয়েছেবাহ্যিক দৃষ্টিতে ভিন্ন সাংষ্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধধর্মের শ্রেণীবিন্যাসকে ভিন্ন মনে হলেও সকল শাখাগুলি প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধধর্মের মূল আবেদন- "চতুরার্য সত্য" ও "আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গের" আদর্শে প্রতিষ্ঠিতঅন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের মতো বৌদ্ধ অঙ্গ বা শাখাগুলি কখনও পরষ্পরের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত হয়নি এক বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি অন্য বৌদ্ধ জনগোষ্ঠির উপসনালয়ে যাতায়াত এবং একত্রে পার্থনা করেনএইরুপ সহ-অবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য অনেক ধর্মগোষ্ঠির মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না
প্রশ্নঃ- আপনি কি বৌদ্ধ হিসেবে বৌদ্ধধর্মকে শ্রেষ্ঠধর্ম ধারণা করে অন্যান্য ধর্মগুলি মন্দ বা ত্রুটিপূর্ণ মনে করেন?
উত্তরঃ না; বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে জ্ঞানী কোনো বৌদ্ধ কখনও তা মনে করেন নাবৌদ্ধদর্শনে সবার প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ চেতনায় এইরুপ সংকীর্ণ চিন্তার অবকাশ নেই বৌদ্ধিক চিন্তাধারা অনুসারে অন্য ধর্ম সম্বন্ধে মন্তব্য করার আগেই অনুসন্ধান করা উচিত নিজ ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের মিল কোথায়ধর্মের নৈতিকতা ভালোবাসা, ধৈর্য্য, ত্যাগ ও সামাজিক দায়িত্ববোধ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, ভাষায়, প্রতীক চিহ্নে ধারণ করেছেসংকীর্ণ জাত্যভিমান, উগ্র ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অসহনশীল অহমিকা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করেপ্রসঙ্গটি প্রতীকরুপে এভাবে কল্পনা করা যেতে পারেঃ- একজন ইংরেজ, একজন ফরাসী, একজন ইন্দোনেশীয়, একজন চৈনিক, প্রত্যকের দৃষ্টি একটি কাপের দিকেইংরেজ বলেছেন এটি কাপ, ফরাসী বলছেন না এটি একটি"টেসী টত্বের" চাইনীজ বলেছেন আপনারা উভয়ে ভুল বলেছেন, এটি হলো একটি "পীই", ইন্দোনেশীয় হেসে বললেন- আপনারা সবাই কী বোকা! এটি হলো "কত্তয়ান্"প্রত্যেকে তাদেঁর ভাষার অভিধান হাজির করে নিজ নিজ বক্তব্যের সারবক্তা প্রমাণ করলেন; কিন্তু কেউ অন্যের অভিধান গ্রহণ করতে রাজী ননপ্রত্যেকে যখন এভাবে নিজ নিজ ভাষায় মৌলিকত্ব, এবং ভাষাভাষী জনসংখ্যার আধিক্যের ঐতিহ্য নিয়ে তর্ক-বিতর্কে উত্তেজিত, তখন একজন বৌদ্ধ এসে ঐ কাপে জলপান করে বললেন, এটিকে আপনারা যে নামেই  জানুন না কেন এর ব্যবহার হলো, এর সাহায্যে জল পান করাআসুন, এর সাহায্যে জলপানে সবাই তৃঞ্চা ও ক্লান্তি নিবারণ করি এবং আনন্দ লাভ করিএই হলো অন্য ধর্মের প্রতি একজন বৌদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গিএই উপমা থেকে বৌদ্ধ দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে
প্রশ্নঃ- বৌদ্ধ দর্শন কি বিজ্ঞান ভিত্তিক?  
উত্তরঃ এ প্রশ্ন জবাব দেয়ার আগে বিজ্ঞান বলতে কি বুঝায় তা আলোচনা করা প্রয়োজন। আভিধানিক সংজ্ঞানুযায়ী বিজ্ঞান হলো বিশেষ জ্ঞান পদ্ধতি, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতায় প্রাকৃতিক যাবতীয় প্রক্রিয়া প্রমাণ করা হয়। বস্তুতঃ প্রকৃতি জগতের সকল প্রক্রিয়া পাকৃতিক পদ্ধতিতে প্রমাণযোগ্য। বৌদ্ধ দর্শনে ব্যাখ্যাত বিষয়গুলো অনুরুপ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতেই প্রমাণিত সত্য। বৌদ্ধদর্শনের মূল "চতুরার্যসত্য" বুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা লদ্ধ বিজ্ঞান প্রক্রিয়ায় উদ্ঘাটিত হয়েছে। চতুরার্যসত্যের প্রথম সত্য দুঃখবোধ, প্রিয়বিয়োগ, অপ্রিয় সংযোগ এবং ইস্পিত বস্তুর অপ্রাপ্তি জনিত কারণে সৃষ্টি হয়। অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির সাহায্যে দুঃখ শনাক্ত, অনুভব ও পরিমাপ করা যায়। দ্বিতীয় সত্যটি, বিজ্ঞানের কার্যকরণ তত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। জীবজগতে কোন ঘটনা তার সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া ঘটতে পারে না। তাই দুঃখেরও সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে। দুঃখের এই কারণটি হলো লাগামহীন চাহিদা। বিষয়টি অভিজ্ঞতায় সনাক্ত ও পরিমাপ করা যায়। বিজ্ঞানের কোন শাখার পরীক্ষাগারে পরীক্ষার সাহায্যে এই দুটি সত্যের যথার্থতা বুঝানোর জন্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। তৃতীয় সত্যটি হল , এই উৎপন্ন দুঃখ নিরোধ করা যায়, দুখের সুনির্দিষ্ট হেতু নিরোধে। অর্থাৎ দুঃখের সুনির্দিষ্ট হেত , অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা রোধ করেই দুঃখ নিরোধ করা সম্ভবকো ন দ্বিতীয় অদৃশ্য শক্তির এখানে ভূমিকা নেই। আপন আচরণের আত্মশক্তির সাহায্যে এ কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। কোনও শক্তির কাছে প্রার্থনা বা পূজা করে ফল প্রাপ্তির আশা করা অবাস্তব।এই সত্যটি স্ব-প্রমাণিত ও স্ব-ব্যাখ্যাত। চতুরার্যসত্যের চতুর্থ সত্যটি হল, দুঃখ নিরোধের উপায়। এর যথার্থতা প্রমাণের জন্যেও পদার্থ বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। দুঃখের মূল কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা, যার নাম তৃঞ্চা। এই অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা রোধের উপায় হলো, ৮টি জীবনাচরণের কর্মপন্থা (আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ)। বিজ্ঞানের মতো বৌদ্ধদর্শনে অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব নেই। প্রকৃতিজগতে পাকৃকি কার্যকারণ, প্রতীত্যসমুৎপাদ প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়। বিশ্বমন্ডলের সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পর্কেও বৌদ্ধদর্শন  ও বিজ্ঞানের প্রতিপাদ্য প্রক্রিয়া অভিন্ন, যেখানে কোন অলৌকিক সত্ত্বারঅস্তিত্ব নেই।বুদ্ধ বার বার উদাত্ত কন্ঠে সাবধান করেছেন। তাড়াহুড়ো না করে, অনুসন্ধানের সাহায্যে যেন সকল বিষয় বিচার করে নেয়া হয়; অন্ধবিশ্বাসে যেন কোন বিষয় সত্য বলে গ্রহণ করা না হয়। প্রাকৃতিক জগতে কিছু বিষয় আছে, বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে বস্তুধর্মী পরীক্ষায় প্রমাণ করা যায়। মনোজগতের সকল বিষয় অনুরুপ পরীক্ষার প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। বিশেষ বিশেষ বিষয় সমূহ বিশেষ অভিজ্ঞতায় স্ব-প্রমাণিত হয়ে স্বতঃসিদ্ধ হয়। দাহ্য বস্তুর সঙ্গে আগুনের সংযোগ ঘটলে আগুন জ্বলে আবার জ্বলন্ত আগুনে জল সংযোগ করা হলে আগুন নির্বাপিত হয়। বিষয়গুলি প্রমাণের জন্যে বিজ্ঞান গবেষনাগারে সরাসরি পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না;অভিজ্ঞতার নিরিখে গ্রহণযোগ্য। বৌদ্ধদর্শনে ব্যখ্যাত দর্শন অনুরুপভাবে বুদ্ধের গভীর মননশীল ধ্যানের অভিজ্ঞতালদ্ধ সত্য। বিজ্ঞানের কোন শাখায় পরীক্ষার সাহায্যে বিষয়টি প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। বুদ্ধ বলেছেন, "প্রচলিত প্রথা, জনশ্রুতি, পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ, বিতর্কের ধাঁধায় প্রমাণিত হয়েছে বলে, ভাববেগ বশতঃ কোন বিষয় গ্রগণ করো না; বরং যা অকুশল, ফলদায়ী নয়, যা জ্ঞানী ব্যক্তি কর্তৃক প্রসংশিত হয়েছে এবং  যা অনুশীলনে প্রকৃত সুখশান্তি লাভ হয়, তা-ই অনুসরণ করো।" (অঙ্গুত্তর নিকায় ১ম খন্ড পৃঃ১৮৮) এই পর্যালোচনা থেকে বোঝা যায়, বৌদ্ধ দর্শন কোনো বস্তুবাদী বিজ্ঞানের শাখা র গোত্রীভুক্ত না হলেও এই জীবন দর্শন বুদ্ধের ব্যক্তিগত সাধনা ও অভিজ্ঞতালদ্ধ বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত। এই প্রসঙ্গে এই যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের অভিমত উল্লেখ্য। তিনি বলেছেন, "ভবিষ্যতে ধর্ম হবে বিশ্বমন্ডলীয় কসমিক্ শক্তি ভিত্তিক। এখানে কোন অলৌকিক সত্ত্বা কিংবা তাত্বিক কল্প কাহিনী থাকবে না।প্রাকৃতিক বস্তুবাদ ও অধ্যাত্মবাদের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে এটি হবে অভিন্ন জীবনদর্শন। বৌদ্ধদর্শন মূলতঃ অনূরুপ চিন্তাধারার জীবন দর্শন। বর্তমান বিজ্ঞান চেতনার সঙ্গে সমঞ্ঝস্যপূর্ণ কোন ধর্ম যদি থেকে থাকে তা হলো "বৌদ্ধধর্ম"।সাম্প্রতিক যুগ সংকটে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বৌদ্ধদর্শন সম্পর্কে এই মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য। মন সকল চিন্তাভাবনায় অগ্রগামী ও প্রধান; মনই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। গরু চালিত গাড়ির চাকা যেমন গরুর পদচতুষ্টয়কে অনুসরণ করে চলে, অনুরুপভাবে যে কোনো কর্ম, বাক্য চিন্তা সম্পাদনকারীকে ঐ চাকার মতো অনুসরণ করে কর্মফল প্রদান করে। 
..........................

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন