কুশল প্রশ্নোত্তর
বৌদ্ধধর্ম
ভদন্ত এস. ধাম্মিকা
অনূবাদকঃ- অধ্যাপক ডাঃ অরবিন্দ বড়ুয়া
প্রথম প্রকাশ
প্রথম প্রকাশ
মে, ২০০৪ সাল, ২৫৪৮ বুদ্ধাব্দ
দ্বিতীয় প্রকাশ
৮ জানুয়ারী, ২০০৬ সাল
শ্রদ্ধাদানঃ- ৩০.০০টাকা
.........................................................
নিবেদন
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বৌদ্ধ দর্শন বিষয়ে বিদগ্ধ লেখকের প্রবন্ধ অবলম্বনে, ভদন্ত শ্রাবস্তী ধাম্মিকা মহোদয় প্রণীত, ‘গুড কোয়েশ্শন গুড আনসারস’ বইটির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা মেটাতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বুড্ডিস্ট এসোসিয়েশন, ইউনাইটেড স্টেট এর সহায়তায় সম্প্রতি বইটির ইংরেজী সংকলন আমেরিকার পাঠকগণের কাছে সহজলভ্য হয়েছে। নিউয়র্ক বুড্ডিস্ট বিহার লাইব্রেরীর সৌজন্যে পাওয়া এই বই এর ইংরেজী সংকলনটি পাঠ করে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য বইটি বাংলায় অনূবাদ করতে আগ্রহী হই। মূলগ্রন্থে আলোচিত বিষয়কে সহজবোধ্য এবং ব্যাখ্যা করার জন্য অনূবাদের সময় শব্দানূবাদের চেয়ে ভাবানূবাদের দিকে সমধিক গুরূত্ব দিয়েছি। বইটি পাঠ করে আমি আশাকরি পাঠক জীবনমূখী বিভিন্ন প্রশ্নের মনোরম উত্তর খূজেঁ পেয়ে শংশয়মুক্ত হবার আনন্দ উপভোগ করবেন।
পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক।
অধ্যাপক অরবিন্দ বড়ুয়া
বৌদ্ধধর্ম
প্রশ্নঃ-বৌদ্ধধর্ম কি?
উত্তরঃ বৌদ্ধ শব্দটি বোধ শব্দ থেকে উদ্ভূত। বোধি বলতে জাগ্রত হওয়া বুঝায় তাই, বৌদ্ধধর্ম জাগ্রত হবার দর্শন। মানবপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম ৩৫ বছর বয়সে ব্যক্তিগত সাধনালদ্ধ অভিজ্ঞতা দর্শনে জাগ্রত হয়েছিলেন। এই ঘটনা আজ থেকে ২৫৪৮ বছর আগের। বর্তমানে সারা বিশ্বে অসংখ্য মানুষ এই দর্শনের অনূসারী। একশত বছর আগে এই ধর্ম শুধুমাত্র এশিয়া মহাদেশে সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রশ্নঃ-বৌদ্ধধর্ম কি তাত্ত্বিক দশর্ন?
উত্তরঃ দর্শনের প্রতিশব্দ ফিলজপি শব্দটি ফিলো এবং সোপিয়া এই দুটি ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে। ফিলো শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা এবং সোপিয়া অর্থ প্রজ্ঞা। ফিলোজপি বলতে বুঝায় প্রজ্ঞা উদ্ভূত ভালোবাসা। প্রকৃতপক্ষে এটিই বৌদ্ধধর্মের শূল বাণী। বৌদ্ধধর্ম মানুষের বুদ্ধি ও মেধাশক্তি বিকশিত করে জীবনের স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করে। এতে আমরা সকল জীবের প্রতি মৈতী-করূণায় উদ্ভূত হই। তাই বৌদ্ধধর্ম শুধূমাত্র তাত্ত্বিক দর্শন নয় বরং জীবনমূখী বাস্তব দর্শন।
প্রশ্নঃ-বুদ্ধ কে ছিলেন?
উত্তরঃ ৬২৪ খ্রীষ্ট পূবে ভারতের এক রাজপরিবারের এক শিশুর জন্ম হয়। রাজ ঐশ্বয্য ও বিলাসে লালিত হলেও কালক্রমে তাঁরএই উপলদ্ধি হয় যে, রাজ ঐশ্বর্য প্রকৃত সুখ শান্তি দিতে পারে না। চারপাশের মানুষের নানা দুঃখ যন্ত্রনা দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। জীবের দুঃখ ও দুঃখের কারণ থেকে মুক্তির উপায় উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে ২৯ বছর বয়সে স্ত্রী-পুত্র, মা-বাবা, রাজ ঐশ্বয্যের বিলাস বহুল জীবন ত্যাগ করে অনিশ্চিত জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে তিনি সংসার ত্যাগ করেন। তৎকালীন মুনী্ ঋষিদের কাছে দুঃখমুক্তির সঠিক সমাধান না পেয়ে অবশেষে তিনি নিজেই সমাধান উদঘাটনের জন্য কঠোর সাধনায় মগ্ন হন। দীর্ঘ ৬ বছরের কঠোর সাধনার পর আপন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জীবনের স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞাত হন। অজ্ঞতা দূর করে জ্ঞান উপলদ্ধি করেন বলে তিনি বুদ্ধ রুপে আখ্যায়িত হন। এরপর মহাপ্রয়ান পযর্ন্ত ৪৫ বছর ধরে সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করে তাঁর লদ্ধ জ্ঞান প্রচার করেন। তাঁর চরিত্রের অনাবিল ধৈয্য, মৈত্রী, করূণার মহিমায় তিনি সকলের কাছে মহিমান্বিত হয়ে উঠেন। পরিশেষে ৮০ বছর বয়সে জীবন জগতের অপ্রতিরোধ্য বাধর্ক্য ও রোগে আক্রান্ত হলেও পরম সুখশান্তি নিয়ে দেহত্যাগ করেন।
প্রশ্নঃ- আপন স্ত্রী-পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ না করে সংসার ত্যাগ করা দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় নয় কি?
উত্তরঃ তাঁর পক্ষে পরিজনদের ছেড়ে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ ছিল না। সংসার ত্যাগের আগে দীর্ঘদিন এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি সংকটে পড়েন। তাঁর কাছে দুটি পথ খোলা ছিল, একদিকে রাজ ঐশ্বয্যের সুখবিলাসে পরিজনের জন্য জীবনযাপন করবেন নাকি বিশ্বের মানুষের কল্যাণের জন্য জীবনয়াপন করবেন? অবশেষে তাঁর করূণাদ্র হৃদয় বিশ্বের মানুষের কল্যাণ ও জীবের দুঃখ মুক্তির জন্য তাকেঁ জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর এই আত্মত্যাগ কি দ্বয়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচায়ক হতে পারে? আসলে এটি ছিল ঐতিহাসিক আত্মত্যাগ যার শুভফল এখনও জগতের মানুষ অবিরত লাভ করে যাচ্ছে।
প্রশ্নঃ- বুদ্ধ তো বেঁচে নেই। তিনি কিভাবে আমাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করবেন?
উত্তরঃ পদার্থ বিজ্ঞানী ফ্যারাডে বিদ্যুত শক্তি আবিষ্কার করেন। এখন তিনি বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর আবিষ্কার কি এখনও আমাদের উপকার করে যাচ্ছে না? চিকিৎসা বিজ্ঞানী লুইস পাস্তুরের আবিষ্কার অদ্যাবধি রোগ নিরাময়ে কাজ করছে, তিনি তো এখন নেই। লিওনার্দো ভিন্সির শিল্পকর্ম তাঁর মৃত্যুর এত দীর্ঘ সময় পরেও মানুষকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে। মনীষীদের মৃত্যু হয়; কিন্তু তাদেঁর অবদান বা কর্মফসল যুগযুগ ধরে আমাদের অনুপ্রাণিত করে দিক নির্দেশনা দেয়। বুদ্ধ এখন জীবিত নেই , কিন্তু তাঁর শিক্ষা, ঝীবনাদর্শ ও উপদেশাবলী আমাদের দুঃখ-দুদর্শা ও সমস্যা উত্তরণের প্রেরণা দিয়ে জীবনধারা বদলে দিচ্ছে। মৃত্যুর পরেও বুদ্ধের মতো মহাপুরুষের কীর্তি শত শত শতাব্দী ধরে এই ক্ষমতা ধারণ করে।
প্রশ্নঃ-বুদ্ধ কি ঈশ্বর ছিলেন?
উত্তরঃ না, বুদ্ধ স্বয়ং ঈশ্বর , ঈশ্বরের প্রেরিত সন্তান কিংবা ঈশ্বরের প্রেরিত দূত ছিলেন না। আমাদের সবার মতো তিনি একজন মানুষ, একজন মানবপুত্র। নিজ কর্মসাধনার অভিজ্ঞতার অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে জগত জীবনের প্রকৃত স্বরুপ জ্ঞাত হয়ে তিনি জ্ঞানের আলোকে প্রজ্ঞাবান হয়েছিলেন। উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করছিলেন, তাঁর উদ্ঘাটিত জ্ঞানের পথে জীবনাচরণ করে যে কোন ব্যক্তি তাঁর মতো বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ করে প্রকৃত সুখ শান্তি লাভ করতে পারেন।
প্রশ্নঃ- বুদ্ধ যদি ঈশ্বর না হন, তাহলে তাঁকে প্রার্থনা করা হয় কেন?
উত্তরঃ বিভিন্ন পদ্ধতির প্রার্থনা আছে। একপ্রকার প্রার্থনা আছে, যেখানে প্রার্থনাকারী তাদেঁর ঈশ্বরের নিকট শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে অভিস্ট পূরণের জন্য প্রার্থনা করেন। এই আশা নিয়ে যে ঈশ্বর তা শুনে পুরণ করবেন। এইরুপ প্রার্থনায় কোন বৌদ্ধ বিশ্বাসী নন। অন্য এক প্রার্থনা পদ্ধতিতে অনুসারীগণ তাদেঁর পূজ্য ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করেন। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় যেইভাবে ছাত্ররা তাঁদের শিক্ষককে দাঁড়িয়ে কিংবা জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত গীতি হবার সময় সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। বৌদ্ধরা এই শেষোক্ত পদ্ধতিতে বুদ্ধকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন।