অগ্রমৈত্রী বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রটি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের মধ্যে তেতুলতলা এলাকায় অবস্থিত। ভাবনা কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালে। কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেন বিদর্শনাচার্য্য শ্রীমৎ তেজবংশ স্থবির। ভাবনা কেন্দ্রটি প্রায় দুই একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। এখানে বিদর্শন ভাবনা প্রশিক্ষণ দেয়া হয় অত্যন্ত যত্ন সহকারে। ভাবনা কেন্দ্রটির অধ্যক্ষ শ্রদ্ধেয় তেজবংশ স্থবির স্বয়ং বিদর্শন ভাবনা প্রশিক্ষণের তদারকি করেন।
প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের দিকে ভাবনা কোর্স শুরু হয়।
বিদর্শন ভাবনা কোর্স একটানা দশদিন। এসময় সাংসারিক সকল কাজ কর্ম ফেলে রেখে ভাবনায় অংশ গ্রহণকারীগণ ভাবনায় নিবিষ্ট হন। ভাবনা চলাকালীন দিনগুলোতে মোবাইল ব্যবহার, বইপড়া, আলাপ-চারিতা একদম বন্ধ। পুরো দশদিন মৌনব্রত পালন করে ভাবনায় মনোনিবেশ করতে হয়।
ভাবনাকারীগণের থাকার ব্যবস্থা ভাবনা কেন্দ্রের ভিতরে। মহিলা ভাবনাকারীদের জন্য আলাদা থাকা, গোছল এবং টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। ভাবনা পরিচালনার জন্য একটি কমিটি করা হয়।
কিভাবে যাবেন:
ঢাকা হতে - ঢাকা হতে সরাসরি চেয়ার কোচে খাগড়াছড়ি নামবেন। ঢাকা কলাবাগান অথবা সায়েদাবাদ স্টেশন হতে শ্যামলী, এস আলম, ষ্টার লাইন ইত্যাদি বাসে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম হতে- চট্টগ্রামের আক্সিজেন স্টেশন হতে শান্তি স্পেশাল বিরতিহীনে চড়ে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়।
খাগড়াছড়ি বাজারে নেমে ইজি বাইকে চড়ে মধুপুর বাজার যাবেন। সেখান থেকে আবার ইজি বাইকে চড়ে তেতুল তলা অগমৈত্রী ভাবনা কেন্দ্রে যাবেন।
বিদর্শন ভাবনা অনুশাসন সহায়িকা
প্রস্তাবনা: পালি "বিপস্সনা" শব্দ থেকে বিদর্শন শব্দটি এসেছে। বিপস্সনা ভারতবর্ষের বহু প্রাচীন সাধনা পদ্ধতি। এ পদ্ধতি আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভগবান গৌতম বুদ্ধ আবিষ্কার করেন।তিনি নিজেই এই পদ্ধতি অনূশীলন করে জ্ঞানের সবোর্চ্চ শিখরে উপনীত হয়েছেন এবং তা সর্বসাধারণের হিতার্থে প্রচার করে গেছেন। বিদর্শন শব্দের অর্থ বিশেষভাবে দর্শন, আত্ম নিরীক্ষণ বা আত্মসমীক্ষণ বুঝায়। ভাবনার গভীরে প্রবেশ করে কায় ও মনের অনুক্ষণ পরিবর্তনশীল অনুভূতিকে নির্লিপ্তচিত্তে দর্শন করাই বিদর্শন।
বিদর্শন ভাবনার উদ্দেশ্য: প্রত্যেক মানুষ রাগ-দ্বেষ-মোহ নামক অন্তর মালিন্যতার অধীন। যে মালিন্যতার কারণে মানুষ নিজেকে যেমন পাপ কার্যের দিকে নিয়ে যায় তেমনি অপরকেও। বিদর্শন ভাবনা হচ্ছে মনের এ সব ক্লেশ বা লোভ-হিংসা-ক্রুরতা ইত্যাদি হতে মুক্তি লাভ করা। রাগ-দ্বেষ-মোহের জটায় জটিত চিত্ত বিদর্শন ভাবনা দ্বারা নির্মল করা যায়। এছাড়াও এর মাধ্যমে শরীর এবং মনের নানাবিধ রোগ নিরাময় হয়। তবে মনে রাখতে হবে যে বিদর্শন ভাবনার উদ্দেশ্য রোগ নিরাময় নয়, বরং পারমার্থিক উন্নতি।
অনুশাসন: বিদর্শন ভাবনা কোর্স মোট দশদিন চলে। যিনি ভাবনা শিবিরে যোগ দেবেন তাকে টানা দশদিন থাকতে হবে। মাঝপথে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ম বিরুদ্ধ। বিদর্শন সাধনা আয়ত্ব করার ক্ষেত্রে এ ক'দিন সময় খুবই কম। তাই সময়ের সদ্ব্যবহার নিতান্ত আবশ্যক। সাধনার সুফল লাভে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে যথা নিয়ম প্রতিপালন পূর্বক নিরন্তর একান্ত মনে সাধনা করে যাওয়া বিশেষ প্রয়োজন। ভাবনা কোর্সের দৈনন্দিন সময়সূচী বা নিয়মাবলী বহু সাধকের অনূভুতি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিজ্ঞান সম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাই অনুশাসন সহায়িকায় প্রদত্ত নিয়ম-কানুন আগে মন দিয়ে পড়ে নিয়ে সেসব নিষ্ঠা সহকারে পালন করতে প্রস্তুত থাকলে তবেই ভাবনা কোসে আবেদন করা উচিত।
নানাবিধ পূজা ও সাধনা বিধির সংমিশ্রণ: বুদ্ধপূজা, সীবলীপূজা, অর্হত পূজা, উপগুপ্ত পূজা, ধূপ, দীপ পূজা, গাথা পাঠ, জপ-তপ, ভজন-কীর্তন, সবকিছু ভাবনায় যোগ দেওয়ার সাথে সাথে ভাবনা কোর্স শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে। যদি বিদর্শন ভাবনার সাথে অন্য বিধির সংমিশ্রণ ঘটে তবে আসল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যাবে।
ভেতর বাহির সম্পর্ক: ভাবনা কোর্সের মধ্যে সাধক-সাধিকাকে পুরো দশদিন কেন্দ্রের সীমানার ভিতরে থাকতে হবে। এ দশদিনের মধ্যে কোন রকম আলাপ-ফোনালাপ বা পত্রালাপ করা যাবে না। ভাবনাকারীর কোন আত্মীয় বা অভিভাবক কোন প্রয়োজনে কেন্দ্রে আসলে তাকে ব্যবস্থাপকের সঙ্গে দেখা করতে হবে, সাধক-সাধিকার সঙ্গে নয়।
অসুখ-বিসুখ: ভাবনা করাকালীন মাথা ধরা, বমি ভাব, প্রচন্ড ব্যথা, শারিরীক-মানসিক অশান্তি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে । এ সময কোন রকম ঔষধ সেবন নিয়ম বিরুদ্ধ। কারোর কোন রোগ ব্যাধি থাকলে তা ভাবনা কোর্সের প্রথম দিনে ভাবনা করার আগে আচার্যকে অবহিত করতে হবে।
আবাসন: স্ত্রী-পুরুষ একসাথে থাকা নিয়মবিরুদ্ধ। আহার, বিহার, সাধন-শয়ন যে কোন সময় কোন রকম যোগাযোগ অবিধেয়। এমনকি ইশারা-ঈঙ্গিতেও।
মৌনতাবলম্বন: ভাবনা শুরুর প্রথম দিন থেকে দশম দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত মৌন থাকতে হবে। অর্থাৎ মৌখিক বা লিখিত বাক্যালাপ এমনকি ইশারা-ঈঙ্গিতেও ভাব বিনিময় করা যাবেনা। অত্যন্ত জরুরী কোন প্রয়োজন হলে ব্যবস্থাপককে স্বল্প কথায় জানাতে পারবেন। তবে তা অন্যান্য সাধক-সাধিকার ক্ষতি না হয় মত উচ্চস্বরে যেন না হয়। ভাবনা সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন থাকলে যথা সময়ে তা জিজ্ঞাসা করবেন। ভাবনায় সাফল্য নির্ভর করবে প্রত্যক ব্যক্তির নিজস্ব প্রয়াসের উপর, অতএব বহুজনের মাঝে থেকেও একাকী, আত্মস্থ হয়ে নিয়ম অনুসরণ করাই বিধেয়।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: দৈনিক একবার স্নানই একজন ভাবনাকারীর জন্য যথেষ্ট। দেহের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি নিজের ব্যবহার্য রুম, স্নানঘর, টয়লেট সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। বেশ-ভূষার ক্ষেত্রে দেহের শুচিতা, পোষাকের শালিনতা ও পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে, মেয়েদের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ(জাল বিশেষ), ফিনফিনে পাতলা বস্ত্র পরিত্যাজ্য। সালোয়ার কামিজের সঙ্গে দোপাট্টা রাখা বিধেয়।
আহার: ভাবনা কোর্সে দৈনিক দুবেলা আহার দুবেলা পানীয় ভাবনাকারীদের জন্য পরিবেশন করা হয়। সকাল ৬টায় যাগু, দুপুর ১১টায় ভাত, বিকাল ৪টায় এবং রাত ৮টায় পানীয় ব্যবস্থা থাকে। কোন রুগ্ন সাধকের চিকিৎসকের পরামর্শে অন্যকিছু পথ্যের প্রয়োজন হলে তা আবেদনপত্রে উল্লেখ করবেন অথবা ব্যবস্থাপককে জানাবেন, পরবর্তীতে তা ব্যবস্থা করা হবে কিনা কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে।
অন্যান্য প্রতিপাল্য বিধি:
*মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, রেডিও, টিভি ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না । ঐসব জিনিস কেন্দ্রে আনলে তা দশ দিসের জন্য অফিসে জমা দিতে হবে।
*যে কোন ধরনের বই, সংবাদপত্র পড়া এবং লেখলেখি দশদিনের জন্য বন্ধ রাখতে হবে।
*যে কোন অলংকারপাতি বা দামী জিনিস ভাবনা শিবিরে না আনাই ভাল। আনলেও তা অফিসে জমা দিতে হবে।
*পান, বিড়ি, সিগারেট,জর্দা, নস্যি ইত্যাদি নেশাদ্রব্য শিবিরে আনা ও ব্যবহার করা অবিধেয়।
*ভাবনা কোর্সে আসার সময নিজের ব্যবহার্য্য জিনিস- ব্রাশ, টুথ পেস্ট, টর্চলাইট, লেপ, তোষক ইত্যাদি সঙ্গে আনতে হবে। মশারি বালিশ কেন্দ্র হতে সরবরাহ করা যাবে।
*বিদেশী সাধক/সাধিকা পাসপোর্ট ভিসা সঙ্গে আনবেন।
*কোন ঘড়ি ব্যবহার অবিধেয়।
আচার্যের সাক্ষাতকার: ভাবনা বিষয়ে বা অন্য কোন বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে চংক্রমনের সময় আচার্যকে বলা যাবে এবং রাত্রে ১০.০০টা হতে ১০.৩০টা পর্যন্ত উদ্ভুত সমস্যা সমাধানের নির্ধারিত সময়ে বলা যাবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আলোচনা তা কোন তাত্ত্বিক বা দার্শনিক বিষয় চর্চার জন্য নয়, কেবল ভাবনার সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা। ভাবনা কোর্স শেষে তুলনামূলক চর্চা করার অবকাশ যথেষ্ট পাবেন।
শীল পালন: বিদর্শন সাধনায় আত্মনিয়োগ করার আগে প্রত্যক উপাসক-উপাসিকাকে অষ্টশীল পালন করতে হবে। অষ্টশীল হচ্ছে আটটি নিয়ম। যথা-
১.প্রাণীহত্যা না করা।
২.চুরি নাকরা।
৩.অব্রহ্মচর্য আচরন না করা।
৪.মিথ্যা কথা না বলা।
৫.নেশা সেবন না করা
৬.দ্বিপ্রহরের পর আহার না করা।
৭.নাচ ও গান বাজনা না করা এবং নানাবিধ অলংকার , প্রসাধনী ব্যবহার না করা।
৮.বিলাসী শয্যা ব্যবহার না করা।
*ভিক্ষু বা শ্রমণ হলে যে কোন ধরণের টাকা-পয়সা বা স্বর্ণ রৌপ্য গ্রহণ না করা এতে সংযুক্ত।
*ভিক্ষু হলে তাকে অবশ্যই আপত্তি দেশনা করতে হবে এবং পাতিমোক্ষ শীলে প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে।
আচার-আচরণ: প্রত্যেকের আচার আচরণ ভাল হওয়া চাই। নিজের চলাফেরায় যাতে অন্যের ক্ষতি না হয় সেদিকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। কেউ কারোর সাথে ঝগড়া বিবাদ করতে পারবেন না।কারোর গর্হিত আচরণে উত্তেজিত হবেন না, নিজেকে বশে রেখে একান্ত মনে ধ্যান চালিয়ে যাবেন।
ব্যয় সংক্রান্ত কথা: ভাবনা কোর্স পরিচালনার ব্যয় ভাবনাকারী এবং দায়কদায়িকাদের স্বেচ্ছাদানের উপর নির্ভর করে। ভাবনা কোর্স সমাপ্ত হলে আপনারাও পরবর্তী ভাবনা কোর্স পরিচালনার সহায়তার জন্য সাধ্যমত দান করে যেতে পারেন। আপনাদের নি:স্বার্থ দান কেন্দ্র নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ব্যয় হয়ে থাকে।
শেষকথা: পূর্বেই বলা হয়েছে বিদর্শন ভাবনার মূল উদ্দেশ্য পারমার্থিক উন্নতি বা আধ্যাত্মিক বিকাশ। যে কোন জন নাম-যশ-খ্যাতি লাভের আশায় দান করা বা ভাবনা করা উচিত নয়। প্রকৃত ভাবনাকারী পরিবারের ও সমাজের সুখী সদস্য হিসেবে বসবাস করতে পারবেন এবং নি:স্বার্থ দাতা ত্যাগের মাঝে বিপুল সুখ লাভ করতে পারবেন। অগ্রমৈত্রী বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আপনাকে সহায়তা করতে আমরা সদা প্রস্তুত।
আপনার সাধনার সাফল্য কামনা করছি।
যোগাযোগ:
ময়মন চাকমা
মেবাইল-০১৫৫৩৭৯০৫৭৯, ০১৮২৬৫৯৪১০৫.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন