লেখক: বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির
বইয়ের নাম: সত্য দর্শন
আমরা বলি, আমার শরীর, আমার জ্ঞান-ধ্যান, আমি সুখ-দু:খ অনুভব করি, আমি দেখি-শুনি, আমার দ্বারা ঘ্রাণন-স্বাদন-দর্শন-স্পর্শন কারয্য সমাপাদিত হয়। চিরাগত প্রশ্ন হইতেছে,- এই শরীরের অধিকারী কে? এই যে তথাকথিত আমি সে কে?
বইয়ের নাম: সত্য দর্শন
আমরা বলি, আমার শরীর, আমার জ্ঞান-ধ্যান, আমি সুখ-দু:খ অনুভব করি, আমি দেখি-শুনি, আমার দ্বারা ঘ্রাণন-স্বাদন-দর্শন-স্পর্শন কারয্য সমাপাদিত হয়। চিরাগত প্রশ্ন হইতেছে,- এই শরীরের অধিকারী কে? এই যে তথাকথিত আমি সে কে?
প্রাচীন কাল হইতেই
দার্শনিকগণ এই সব প্রশ্নের বিচার করিয়া আসিতেছেন, এই আমি কে?প্রশ্ন খুব সহজ,
উত্তরও সরল বলিয়াই আমাদের ধারণা। আমরা মনেকরি আমার শরীর, আমার চক্ষু-কর্ণাদি বলিতে
এখানে না বুঝিবার কি আছে? কিন্তু আসলে তাহা নহে। প্রশ্নটি স্বভাব-গম্ভীর। এইজন্য
দার্শনিকগণ বিভিন্ন মত পোষণ করিয়াছেন ও ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিয়াছেন।
কেহ কেহ বলেন- ব্যক্তির পশ্চাতে এমন এক সত্তা আছে, যিনি
শরীরের কর্ত্তা, জ্ঞানের জ্ঞাতা, সুখ-দু:খের ভোক্তা, দ্রষ্টা, ঘ্রাতা, স্বাদেতা,
স্পর্শেতা, ইনিই হইতেছেন আমাদের আত্মা। কেহ বলিয়াছেন পুরুষ, কেহ বলিয়াছেন জীব। কিন্তু
এই শ্রেণীর ভিন্নতায় কিছু আসিয়া যায় না। সকলে একটি কিছু লক্ষ্য করিয়াছেন, ইহা
একান্ত সত্য। এই আত্মাই শরীর ও মনের পরিচালক। জানন, ভোজন, দর্শন, স্পর্শন,ধারণ
গমনাদি জ্ঞান ও কর্ম্মেন্দ্রিয় গ্রামের সাহায্যেই তিনি সম্পাদন করিয়া থাকেন।
আত্মা, মন ও শরীরের পরে।মন ও শরীরের তিনি একমাত্র কর্ত্তা ও সর্বেসব্বা।
এই মতবাদে আজও
পৃথিবীর বহু বিজ্ঞাবিজ্ঞ লোক প্রতিষ্ঠিত। তথাগত
বুদ্ধ্বই সর্ব্ব প্রথম এই মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি অনাত্মাবাদী,
সন্ততিবাদী। একদা পৃথিবী এই অনাত্মবাদকে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে গ্রহণ করিয়াছিল। আজও
অনাত্মবাদীর সংখ্যা তুল্য তুল্য বলিতে হইবে।
জাতিস্মর
জ্ঞান ও সংক্রমণ স্বীকার না করিয়া আপাতত: কিরূপে পারা যায়? কিন্তু
আত্মার(বিজ্ঞানের) ভিন্ন দেহ সংক্রান্তি অস্বীকার করিয়া তথাগত “সাতি” নামক ভিক্ষুকে তিরষ্কার
করিয়াছিলেন। তাঁহার মত এই য়ে,- বিজ্ঞান তথাকথিত আত্মা ও প্রতীত্য সমুতপন্ন ধর্ম্ম।
প্রত্যয় ভিন্ন বিজ্ঞানের উতপত্তি অসম্ভব।
বহু জলানুর স্রোতরূপে প্রবাহমান সন্ততিকে যেমন আমরা নদী বলি, বহু বিজ্ঞানের
সন্ততিকে তেমনই আত্মারূপে সাধারণভাবে আমরা গ্রহণ করিয়াছি। জলানুর স্রোতই সত্য,
নদী ব্যবহার মাত্র। আত্মাও ব্যবহার মাত্র, বিজ্ঞান সন্ততিই সত্য। যাজ্ঞবল্ক্য
আত্মাকে ইহ পর জন্মের সেতু রূপে বর্ণনা করিয়াছেন, কিন্তু তথাগত কর্ম্মকেই সেতুরূপে
স্থাপন করিয়াছেন। দীপ্ত দীপ হইতে, অন্য অদীপ্ত দীপ দীপ্ত করিলে যেমন পূর্ব্ব
দীপ্তির সংক্রমন হয় না, অথবা গুরু হইতে ছাত্র মন্ত্র শিক্ষা করিলে, যেমন গুরু
মন্ত্রহীন হন না, তদ্রুপ আত্মার (বিজ্ঞানের) সংক্রান্তি না হইলেও সংষ্কার-প্রত্যয়
লাভে, পরজন্মে উহার অস্তিত্বের বিকাশ হয়। সে আত্মা (বিজ্ঞান) সেও নহে, পূর্ব্ব
বিজ্ঞানকেই (আত্মাকেই) অবলম্বন করিয়া পর
বিজ্ঞান সম্ভব হইয়াছে।
বেদান্ত
দর্শনে কারণ শরীরের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এই কারণ শরীর যদি ভবাঙ্গ চিত্তই হয়,
তবে বিশেষ গোলে পড়িতে হয় না। ভবাঙ্গ অন্যান্য চিত্তের ন্যায় সক্রিয় নহে। ইহা অতি
সুক্ষ্ম স্পর্শ-বেদনা-সংজ্ঞা-চেতনা-একাগ্রতা-মনষ্কার জীবেতেন্দ্রিয় ও অন্যান্য
চৈতসিক সম্পর্কিত। ভবাঙ্গের একমাত্র প্রকাশ সুসুপ্তি। সমুদয় চিত্ত মহুর্মুহু
উতপন্ন হইয়া বিলয় প্রাপ্ত হইতেছে।প্রতি চিত্তই কিন্তু অভিনব। কিন্তু ভবাঙ্গ জন্ম
হইতে মৃত্যু পযর্ন্ত প্রতিচিত্ত বীথির আদিতে ও অন্তে সমুদিত হইয়া চিত্তোতপত্তির
অবকাশ প্রদান করিয়া থাকে; কিন্তু সে স্বয়ং পুরাতন সদৃশ, অভিনবত্ব তাহার নাই। পুনর্জন্মেই
সে অভিনব হয়, জীবের কৃতকর্ম্মানুসারে। যদি এই কারণ শরীর , কর্ম্ম-কারণ জাতীয় হয়
তবে বৈদান্তিক আত্মা বৌদ্ধ বিজ্ঞান সন্ততির রূপ ধারণ করে এবং উভয় জাতীয় আত্মার কোন
ভেদ থাকে না। ব্রহ্মবাদেও না। ভেদ থাকিয়া যায় মুক্তি বিমুক্তির মধ্যে। বেদান্তে
ব্রহ্ম বৈলিন্যই মুক্তি, এরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে। তথাগত উহা সায়ুক, সসীম মুক্তি
মাত্র বলিয়া, বিজ্ঞান সন্ততির প্রবাহ ছিন্নকেই বিমুক্তিরূপে দেখাইয়াছেন। সইচ বিকল
হইলে যেমন বিজলী ধারা রুদ্ধ হয় এবং তত্ সঙ্গেই বাতি নিভিয়া যায়, এইরূপ বিজ্ঞান
সন্ততি বিকল হইয়া গেলে তৃঞ্চাধারাও রুদ্ধ হইয়া যায়। তৃঞ্চার নিরোধে আত্মারূপ
জীবনদীপ চিরতরে নিবৃত্ত হয়।
তথাগত
বুদ্ধ কিরূপে বহুজনে প্রতিষ্ঠিত আত্মবাদ খন্ডন করিয়াছিলেন, মহাপন্ডিত গ্রীকরাজ
মিলিন্দের প্রশ্নে ও বিচিত্রবাদী মহাভিজ্ঞ স্থবির নাগসেনের উত্তরে, স্পষ্টানুভূতি
পাওয়া যাইবে। চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ সাধারণত: ঈশ্বর-অনীশ্বর আত্মা-অনাত্মা বিষয়েই প্রথমে
চিন্তা করিয়া থাকেন। ইহা যেন একান্ত স্বাভাবিক। মহারাজ মিলিন্দও প্রথমে প্রশ্নে
উহাই গ্রহণ করিয়াছিলেন:-
মিলিন্দ-
ভন্তে! আপনি কিরূপে জ্ঞাত হইয়া থাকেন? আপনার নাম কি?
নাগসেন-
মহারাজ! আমি নাগসেন বলিয়া জ্ঞাত, নাগসেন কিন্তু সংজ্ঞা প্রকাশ ব্যবহার ও নাম
মাত্র, এখানে কোন ব্যক্তি বা অবযবী উপলদ্ধি হয় না।
মিলিন্দ-
যদি ভন্তে ব্যক্তি না থাকে, তবে কে আপনাকে চীবরাদি ও চতুষ্টয় দান করে, কে উপভোগ
করে, কে ভাবনা অভ্যাস করে, কে মাগর্ফল প্রত্যক্ষ করে,কে প্র্রাণী হত্যাদি পঞ্চ
অকুশল কর্ম সম্পাদন করে? তাহা হইলে কুশল নাই, অকুশল নাই, কুশলাকুশলের কর্ত্তা নাই,
কারয়িতা নাই, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফলও নাই।আপনাকে যদি কেহ হত্যা করে তাহা হইলেও
হত্যাকারীর কোন পাপ হইবে না। আপনার আচায্য নাই, উপাধ্যায় নাই, উপসম্পদাও নাই। আপনি
যাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন যে মহারাজ! আমি নাগসেন বলিয়া জ্ঞাত। এখানে সেই নাগসেন
কে? ভদন্ত! কেশগুলি কি নাগসেন?
নাগসেন-
না মহারাজ।
মিলিন্দ-
লোম, নখ, দন্ত, ত্বক, মাংস নাগসেন?
নাগসেন-
না মহারাজ।
মিলিন্দ-
রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংষ্কার, বিজ্ঞান নাগসেন?
নাগসেন-
না, না, না মহারাজ।
মিলিন্দ-
তবে কি ভন্তে! রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংষ্কার, বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টিরূপে
নাগসেন?
নগসেন-
না, মহারাজ।
মিলিন্দ-
ভদন্ত! আপনাকে জিজ্ঞাসা করিয়া করিয়া নগসেনকে পাইলাম না। নাগসেন কি তবে শুধু শব্দই?
বিদ্যমান নাগসেন কে তবে? আপনি মিথ্যা বলিয়াছেন, নাগসেন নাই।
নাগসেন-
মহারাজ, আপনি ক্ষত্রিয়-কুমার, সুকোমল শরীর আপনার, মধ্যাহ্ন সময় এখন, ভূমি তপ্ত,
উঞ্চ বালুকার উপর তীক্ষ্ম কাঁকর, ভগ্ন মৃৎপাত্র সমূহ মর্দন করিয়া পদব্রজে আসায়
সম্ভবত: আপনার চরণ উপহত হইয়াছে, শরীরও বোধহয় ক্লান্ত হইয়াছে?
মিলিন্দ- আমি রথে করিয়া আসিয়াছি ভন্তে,
আমার বিন্দুমাত্র ক্লান্তি হয় নাই।
নাগসেন- মহারাজ আপনি যদি রথে আসিয়া থাকেন,
তবে রথ কি তা আমাকে বলুন। ঈশা কি রথ?
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
নাগসেন- অক্ষ, চক্র, পঞ্জর, দন্ড, রজ্জু,
প্রতোদ দন্ড কি রথ?
মিলিন্দ-না,না,না ...ভদন্ত।
নাগসেন-তবে কি মহারাজ ঐগুলির সমষ্টিরূপে
রথ?
মিলিন্দ-না ভদন্ত।
নাগসেন- আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিয়া করিয়া
হয়রাণ হইলাম, অথচ রথ দেখিতে পাইতেছি না। মহারাজ, রথ কি তবে কেবল শব্দমাত্র? তবে
এখানে বিদ্যমান রথ কি?আপনি মিথ্যা বলিয়াছেন, এখানে রথ নাই।
মিলিন্দ- ভদন্ত! আমি মিথ্যা বলি নাই। ঈশা
চক্রাদির সমবায়ে সুসংবদ্ধতা হেতু রথ। ইহা সংজ্ঞা প্রকাশ, ব্যবস্থারও নাম মাত্র।
নাগসেন- সাধু, সাধু, মহারাজ রথ কি তাহা
আপনি ভাল জানেন। ঠিক এইরূপই মহারাজ! কেশ-লোমাদি রূপ এবং
বেদনা-সংজ্ঞা-সংষ্কার-বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধ হেতুই নাগসেন। এইগুলিকে আশ্রয় করিয়াই
নাগসেন সংজ্ঞা, ব্যবহার, প্রকাশ ও নাম মাত্র প্রবর্ত্তিত হইতেছে। পরমাথর্ত: এখানে
পৃথক কোন ব্যক্তি বা অবয়বীস্বরূপ লোকের বা আত্মার উপলদ্ধি হয় না।
মিলিন্দ- সাধু, সাধু, ভন্তে নাগসেন, অতি
সুন্দর ও বিচিত্র রূপে আপনি উত্তর প্রদান
করিয়াছেন।
মন্ত্রী অনন্তকায়ের প্রশ্ন
অনন্তকায়- ভদন্ত নাগসেন! এই যাহাকে আমি
নাগসেন বলিতেছি, সেই নাগসেন এখানে কে?
নাগসেন- আপনি কাহাকে নাগসেন মনে করেন?
অনন্তকায়- আমি মনেকরি যে, সেই অভ্যন্তরস্থ
বায়ুই নাগসেন; যাহা প্রবেশ করিতেছে আর নিষ্ক্রান্ত হইতেছে।
নাগসেন- যদি এই বায়ু নিষ্ক্রান্ত হইয়া আর
প্রবেশ না করে, অথবা প্রবেশ করিয়া আর নিষ্ক্রান্ত না হয়, তবে কি সেই পুরুষ জীবিত
থাকিবে?
অনন্তকায়- না ভদন্ত।
নাগসেন- এই য়ে শঙ্ক বাদকেরা শঙ্ক বাদন করে,
সেই বায়ু কি তাহাদের মধ্যে পুনরবার প্রবেশ করে?
অনন্তকায়- না ভদন্ত।
নাগসেন-তাহা হইলে শঙ্ক বাদকেরা মরে না কেন?
অনন্তকায়- আপনি বাদী, বিচারশীল, আপনার সহিত
আলাপ করিতে আমি অসমর্থ।
ভাল ভদন্ত, এখানে তত্ত্ব কথা কি তাহা আপনি
আমাকে বলুন।
নাগসেন- বায়ু ঝীব নহে, ইহা আশ্বাস-
প্রশ্বাস, শরীরের ধর্ম্ম।
মিলিন্দরাজের প্রশ্ন
মিলিন্দ- ভদন্ত নাগসেন, বেত্তার (আত্মার)কি
উপলদ্ধি হয়?
নাগসেন- বেত্তা আবার কে?
মিলিন্দ- এই অভ্যন্তরের জীব। যে চক্ষুর
দ্বারা দর্শন করে, শোত্র দ্বারা শ্রবণ করে, ইত্যাদি। যেমন, আমরা এই প্রাসাদে
উপবেশন করিয়া পূর্ব্ব-দক্ষিণাদির যে যে বাতায়ন পথে ইচ্ছা করি, সেই সেই বাতায়ন
দ্বারাই দর্শন করিতে পারি। এইরূপ অভ্যন্তরস্থ জীব, যে যে ইন্দ্রিয় দ্বারা দেখিতে
ইচ্ছা করে, শুনিতে ইচ্ছা করে, তাহা দ্বারাই দর্শন, শ্রবণ কৃত্যাদি সম্পাদন করে।
নাগসেন- যদি অভ্যন্তরস্থ জীব, চক্ষু দ্বারা
দর্শন করে, তবে শোত্র-ঘ্রাণ-জিহ্বা-ত্বক দ্বারাও কি সে শুধু রূপই দর্শন করে? যেমন
প্রাসাদে বসিয়া সকল বাতায়ন দিয়াই আমরা কেবল রূপই দর্শন করিয়া থাকি।
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
নাগসেন- মহারাজ! অভ্যন্তরে যে জীব আছে,
তাহার জিহ্বায় কোন রস নিক্ষিপ্ত হইলে সে অম্লত্বাদি রস সম্বন্ধে জ্ঞাত হইবে কি?
মিলিন্দ- হাঁ ভদন্ত, জ্ঞাত হইবে।
নাগসেন- ঐ রস যদি ভিতরে প্রবেশ করে, তবে কি
সেই জীব(আত্মা) তাহার অম্লত্বাদি রসের বিষয় জানিতে পারিবে?
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
নাগসেন- আপনার পূর্ব্বাপর কথার সহিত সংগতি
হইতেছে না।মধুদ্রোণিতে মধুপূর্ণ করিয়া যদি কোন ব্যক্তির মুখ বন্ধন পূর্ব্বক উহাতে
নিক্ষেপ করে, তবে কি সেই অভ্যন্তরস্থ জীব জানিতে পারিবে যে মধু মিষ্ট কি তিক্ত?
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
নাগসেন- কারণ কি? যেহেতু তহার জিহ্বায় মধু
স্পর্শিত হয় নাই।
নাগসেন- আপনার পূব্র্বাপর কথার সঙ্গতি
হইতেছে না, মহারাজ।
মিলিন্দ- আপনি বাদী, আপনার সহিত আলাপে আমি
সমর্থ নহি। আমাকে তত্ত্ব কথা বলুন।
নাগসেন- চক্ষু-রূপ-আলোক ও মনষ্কার হেতু
চক্ষুবিজ্ঞান যেমন উতপন্ন হয়, তৎসহজাত স্পর্শ-বেদনা- সংজ্ঞা-চেতনা-একাগ্রতাদি
চৈতসিকও তেমন উতপন্ন হয়।
ইহারা একসঙ্গে উদয় হয় এবং একই সঙ্গে
নিরুদ্ধ হয়। এই চিত্ত-চৈতসিক আবার একই আলম্বনকে (বিষয়কে) আশ্রয় করে। তথা
শ্রোত্র-শব্দ-ইথার মনস্কার হেতু শ্রোত্র বিজ্ঞান এবং সহজাত স্পর্শ বেদনাদি চৈতসিক গুলিও এক সঙ্গে নিরুদ্ধ হয়। তথা
ঘ্রাণ জিহ্বাদি সম্বন্ধেও একই তত্ত্ব। এখানে শাশ্বত বেত্তার উপলদ্ধি হয় না। চৈতসিক
বেদনাই বেত্তা, সংজ্ঞা, জ্ঞাতা, চেতনা, চেতেতাম জীবেতেন্দ্রীয় জীবেতা, বিজ্ঞান
বিজ্ঞেতা, মনস্কার, নিবেশেতা, একাগ্রতা ধারেতা।যখন যে ইন্দ্রিয় দ্বারে যে বিষয়
আলম্বিত হয়,সেই দ্বারেই সেই বিজ্ঞান ও ঐ সপ্ত চৈতসিক সর্ব্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক।
ইহা ছাড়াও অন্যান্য চৈতসিক ও অধিকার হিসাবে উতপন্ন হইয়া থাকে। এই পর পর উতপন্ন
বিজ্ঞান সমূহকে চৈতসিক জীবেতেন্দ্রিয়ই সঞ্জিবিত রাখে এবং পূর্ব্ব পূর্ব্ব
বিজ্ঞানের একটা ছাপ পর বিজ্ঞানে সমুদিত হয়। এইজন্য বিজ্ঞান বহু হইয়াও এক বলিয়া
আমরা ভ্রম করি।
মিলিন্দ-
ভদন্ত, আপনি সুপন্ডিত।
ঈশ্বরবাদের
সহিত আত্মবাদের অনীশ্বরবাদের সহিত অনাত্মবাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। প্রত্যেক দুই
তত্ত্বের যে কোন একটির সন্ধান মিলিলে অন্য তত্ত্বটি আপনি আসিয়া পড়ে। আত্মবাদীগণ
অাত্মা ও ঈশ্বর অদ্বয় মনে করেন, অনাত্মবাদীগণ অনাত্মায় ও অনীশ্বরে ভিন্নতা বোধ
করেন না।
অনিত্য,
দু:খ, অনাত্মন বিশ্বের এই
লক্ষণত্রয়ে ভগবান বুদ্ধের দার্শনিক-বিচার মূর্ত্ত হইয়াছে। পিটকে ত্রিলক্ষণ দীপ্ত
নাম-রূপ-তত্ত্বের তিনটি বিভাগে বিস্তৃত আলোচনার সমবেশ আছে- স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু।
স্কন্ধ
বা খন্ধ- খং অত্তসুঞ্ঞং ধারেতী’তি
খন্ধো। আত্ম শূন্যতাকে ধারণ করে বলিয়া স্কন্ধ বলে। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংষ্কার,
বিজ্ঞান ভেদে স্কন্ধ পাঁচটি। নাম ও রূপ ভেদে দ্বিবিধ।
রূপস্কন্ধ-
চতুর্মহাভূত এবং ভূত সমুতপন্ন যাহা কিছু সবই রূপ স্কন্ধের অন্তগর্ত।
বেদনাস্কন্ধ-
সুখ, দু:খ, অদু:খ-অসুখ, এই অনুভূতিত্রয় রূপ-রসাদি বিষয়ভেদে শত-সহস্র প্রকারে
সমুদ্ভুত হয়। এই বেদনা রাশিই বেদনা স্কন্ধ।
সংজ্ঞাস্কন্ধ-
লোহিত, পীত, নীলাদির ন্যায় স্বতন্ত্র বস্তু বিষয়ে পৃথক পৃথক জ্ঞান লাভ। এই রাশিকে
সংজ্ঞাস্কন্ধ বলে।
সংষ্কার-স্কন্ধ-
কুশল, অকুশল ও অব্যাকৃত (কুশলাকুশল হিসাবে অবিভক্ত)চেতনারাশি সংস্কারস্কন্ধ।
বিজ্ঞানস্কন্ধ-
বেদনা ও সংজ্ঞাস্কন্ধের বহু বিজ্ঞাতা, বিজ্ঞান-রাশি বিজ্ঞানস্কন্ধ। এই স্কন্ধ সমূহ
অনিত্য, সংষ্কৃত, প্রত্যয়-সমুদিত, ক্ষয়শীল, ব্যয়শীল এবং নিরোধ স্বভাব।
আয়তন-
“আয়ো’তিরাসি, রাসিভূতং দুক্খং তনোতি
বিত্থারেতী’তি আয়তনং” আয়ো অর্থে রাশি সমূহ, রাশীভূত
দু:খকে সংসার পথে বিস্তৃত করে বলিয়া আয়তন বলা হয়। চক্ষু, শ্রোত্র, ঘ্রাণ, জিহ্বা,
কায়, মন এবং আধ্যাত্মিক আয়তন সমূহের পথগামী বাহ্যিক রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ,
ধর্ম্মায়তন। এই দ্বাদশ আয়তন। দ্বার ও অবলম্বনের (বিষয়ের) আকারে বিজ্ঞানের উতপাত্তি
ও নিবাসস্থল।
ধাতু-
“অত্তনো সভাবং ধরেতী’তি ধাতু, অথবা সংসার দুক্খং
ধারেতী’তি ধাতু”। নিজের স্বভাব ধারণ করে বলিয়া
ধাতু। অথবা সংসার দু:খ ধারণ করে এই অর্থেও ধাতূ। চক্ষাদি ষড়েন্দ্রিয়, রূপাদি ষড়
বিষয়, চক্ষু ও রূপাদিতে উতপন্নচক্ষুবিজ্ঞানাদি ষড় বিজ্ঞান; এই আঠারপ্রকার ধাতু।
ইহারা প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বভাব ধারণ করে, পরস্বভাব ধারণে সম্পূর্ণ অসমর্থ।
দর্শন-কাজের সহায়তা করিবার সামর্থ্য কেবলই চক্ষাধীন।‘চক্খতী’তি চক্খু” রূপের রস আস্বাদন করিবার শক্তি ধারণ
করে বলিয়া চক্ষু-ধাতু বলা হয়, কিন্তু শ্রোত্র রূপেররস আস্বাদনের ক্ষমতা রাখে না।
সে কেবল শব্দেরই রস পানে বা শ্রবণে সাহায্য করিতে সমর্থ। সেজন্যসে শ্রোত্রধাতু তথা
ঘ্রাণ, জিহ্বাদি ধাতু।
বুদ্ধ
বলেন- রূপাদি স্কন্ধপঞ্চ অনিত্য, অধ্রূব, অশাস্বত এবং বিকারী। সংসারে ইহা একান্ত
পন্ডিত সম্মত, আমারও এইরূপ মত। এইরূপ বলিবার বুঝাইবার পরেও যে বুঝিতে পারে না,
দেখেনা, সে অন্ধ, বাল। অন্ধ-অজ্ঞের জন্য আমি কি করিতে পারি! ভিক্ষুগণ! ইহা নিশ্চয়
স্বাভাবিক যে-যাহারা অজ্ঞান, তাহারা এই চতুর্মহাভূত সমুতপন্ন দেহকেই আত্মা বা
নিত্য বলিয়া জানিবে। কেননা, এই দেহ দীর্ঘদিন বিদ্যমান থাকে। উহার সুক্ষ আহার ও ঋতু-চিত্ত-সুতপন্ন
রূপ-প্রবাহ সহজে দৃষ্টিগোচর নহে। কিন্তু চিত্তের মূহুমূর্হু বিভিন্নতা এবং উদয়-ব্যয়তা
প্রতিক্ষণেই অনুভব যোগ্য। উহাকে কিরূপে নিত্যতত্ত্ব মানা যাইতে পারে?
“রূপং দ্বন্ধ নিরোধং গরু পরিয়ত্তি
চিত্তং
ত্থিপ্প নিরোধং লহুপরিয়ত্তি”।
তথগত
বুদ্ধের অনিত্যবাদ- অন্য উতপন্ন হয়, অন্য নিরুদ্ধ হয়। কোন এক মৌলিকতত্ত্বের
বাহ্যিক পরিবর্তন মাত্র নহে। একের সম্পূর্ণ নিরোধে অন্যের যুগপত সমুতপাদ। বুদ্ধ
কায্য-কারণের অবিচ্ছিন্ন সন্ততি মানিতেন না, বিচ্ছিন্ন বলিয়াও বলিতে চাহেন নাই।
কারণ, চিত্তোতপত্তির কোন না কোন এক বা একাধিক প্রত্যয় থাকিবেই। উদয়-ব্যয়ের
অপূর্ব্ব অচরিমতার দ্বারাই চিত্ত সন্ততি জ্ঞাতব্য। হেতু আর প্রত্যয় সমান অর্থ বাচক
শব্দ নহে। হেতু মূল-নিদান; যথা-বীজ। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত প্রত্যয়ে বীজ
বৃক্ষাকারে পরিণতি লাভ করে। সুতরাং ক্ষিতি-অপাদি প্রত্যয়।
আমি
একটি গোলাপ ফুল দেখিতে পাইতেছি। এই গোলাপটি দেখিবার কতকগুলি প্রত্যয় বা সহায়তাকারক
ধর্ম্ম আছে, যাহা যাহা পূর্ণরূপে থাকিলে গোলাপটি দৃষ্ট হয়, উহাদের একটি মাত্রও না
থাকিলে দৃষ্ট হয় না। গোলাপ, চক্ষু, পঞ্চদ্বারাবর্তন-চিত্ত বা মনস্কার, আলোক ও
চক্ষুবিজ্ঞান এই প্রত্যয় চতুষ্টয় সমভাবে একমুখী হইয়া বিদ্যমান থাকিলে বিজ্ঞান
কর্ত্তৃক গোলাপ দৃষ্ট হইবে এবং বেদনা, সংজ্ঞা, সংষ্কারাদি উতপন্ন হইবে। অদৃষ্টে
বেদনাদির উতপত্তি হয় না। প্রত্যয় সমুতপন্ন যাহা কিছু, তৎসমুদয় ভঙ্গুর, সুতরাং অনিত্য, অসার, সকোঠিক
মধ্য-ব্যক্ত। বুদ্ধের সমগ্র দর্শনের আধার এই প্রতীত্য-সমুতপাদ-নীতি।
তথাগত
বুদ্ধ “প্রতীত্যসমুতপাদ” এই বাক্যাংশের “প্রতীত্য” শব্দে শাশ্বত বাদ ও “সমুতপাদ” শব্দে উচ্ছেদ বাদ খন্ডন করিয়া,
উভয় পদে মধ্যম প্রতিপদা স্থাপন করিয়াছেন। কারণ, ব্রহ্মজাল সূত্রে দেখা যায়,
পূর্ব্বে উপনিষদের ঋষিগণ আত্মার বহুল প্রচারে নিযুক্ত ছিলেন। নিগ্রন্থনাথ পুত্রও
আত্মবাদ স্বীকার করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার মতে আত্মা এক এবং অখন্ড নহে, বহু
আত্মা। ভৌতুকী(ভূত বাদীর সংখ্যা)ও কম ছল না।
আত্মা,
রূপী ও অরূপী ভেদে দ্বিবিধ। কাহারো কাহারো মতে আত্মা শান্ত, কাহারো কাহারো মতে
অনন্ত। নিত্যানিত্য বশে ও বিভেদ দৃষ্ট হয়। উপনিষদের এই সব দার্শনিক তত্ত্বকে তথাগত
দৃষ্টি জাল বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
“দ্বীহি ভিক্খবে দিটঠিগতেঞি
পরিযুটঠিতা দেব মনুস্সা
ওলিযন্তি
একে, অতি ধাবন্তি একে, চক্খু মন্তাব পস্সন্তি”।
ভিক্ষুগণ, কী দেবতা,
কী বা মানুষ দ্বিবিধ মিথ্যা-দৃষ্টি জালে সম্পরিকীর্ণ। কেহ অবলীন হইতেছে, কেহ বা
অতি ধাবিত হইতেছে। যাহারা চক্ষুষ্মান শুধু তাঁহারাই দেখিতে পান।
যাহারা ভবারাম,
ভবরত, তাহাদিগকে যদি ভব-নিরোধ বিষয়ে অনুশাসন করা হয় তাহাদের চিত্ত উহা গ্রহণ করে
না, প্রসাদ লাভ করে না, শ্রদ্ধান্বিত হয় না; তাহাদের চিত্ত অবলীন হয়। আর যাহাদের
চিত্ত ভবের প্রতি ঘৃণা পরায়ন, দু:খ-দর্শী, ভবগ্রহণে লজ্জাশীল তাহারা বিভবই অভিবাদন
করেন। তাহারা চিন্তা করেন-এই আত্মা দেহত্যাগের পর উচ্ছিন্ন হইবে, বিনাশ হইবে। জন্মান্তর
মিথ্যা, কুশলাকুশল কর্মও মিথ্যা। আত্মার উচ্ছেদই যথার্থ শান্তি। এইরূপে অতি ধাবিত
হয়। আর যাহারা জড় চেতন বা নাম-রূপকে প্রতীত্য-সমুতপাদ বলিয়া জানেন, অনিত্য, অসার
বলিয়া জানেন ও সম্পজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হন, কর্ম্ম ও কর্মফলে বিশ্বাসবান এবং হেতুবশে
জন্মান্তর ও হেতুক্ষয়ে জন্ম-নিরোধে শ্রদ্ধা সম্পন্ন, তাঁহারাই চক্ষুষ্মান। অনুরূপ
দৃষ্টি ইহাদেরই হয়। যেমন- দারু-যন্ত্র আত্মাশূন্য, নির্জীব, নিশ্চেষ্ট, কিন্তু
দারু-যন্ত্র রজ্জুসম্প্রযোগে যেমন নাচে, চলে নানাবিধ শরীর বিকার প্রদর্শন করে, মনে
হয় যেন উহা সজীব, সচেষ্ট, সব্যাপার। তদ্রূপ নাম-রূপ আত্মাশূন্য, নির্জীব,
নিশ্চেষ্ট, অথচ পরষ্পর সম্প্রয়োগে, সজীব, সচেষ্ট সব্যাপার ও সাত্ম বলিয়াই অনুভূত
হয়।
এই
‘নামরূপ’ পরস্পরাশ্রিত নলকলাপের ন্যায়,
একটির পতন ঘটিলে অন্যটির পতন অনিবায্য। দন্ডাভিঘাত প্রাপ্ত ভেরী হইতে শব্দ
প্রবত্তির্ত হয় বটে কিন্তু ভেরী অন্য, শব্দ অন্য; পরস্পর অসংমিশ্রিত। ভেরীতে যেমন
শব্দ নাই, শব্দেও ভেরী নাই।ঠিক এই রূপই বাস্তুদ্বারাবলম্বনকে আশ্রয় করিয়াই নাম
প্রবর্ত্তিত হইলেও নাম ও রূপ পরস্পর স্বতন্ত্র ও অসংমিশ্রিত। দন্ডাভিঘাত প্রাপ্ত
ভেরীসমুতপন্ন শব্দেরই মত, রূপের সাহায্য লইয়া নাম প্রবর্ত্তিত হয়। (অর্থাত,
ভেরীর এক পাশ্বে চিনি লেপন করিয়া, অপর
প্রান্তে কাঠির দ্বারা আঘাত করিলে উভয় পাশ্ব একবদ্ধতা জন্য যেমন ভেরীতলে উপবিষ্ট
মক্ষিকা-কম্পিত হইতে থাকে, সেইরূপ চক্ষুদ্বার-বীথিতে রূপ যখন চক্ষু-প্রসাদে সংঘটিত
হয়, তখন একবদ্ধ হৃদয় বস্তুতে আশ্রিত ভবাঙ্গও কম্পিত হইতে থাকে।ভবাঙ্গ চলনে বীথি-চিত্তের চিত্ত সমুদয় একের পর অন্য করিয়া
চলিতে চলিতে জবন-ক্ষেত্রে লোভ-দ্বেষ-মোহ ও অলোভ-অদ্বেষ-অমোহ মূলীয় অকুশল ও কশল
কর্ম্ম সম্পাদন করে।এইরূপে-রূপের প্রত্যয় লাভ করিয়া, নাম বা চিত্ত-চৈতসিক
প্রবর্ত্তিত হইয়া থাকে।)
চক্রাদি
যাবতীয় অঙ্গ-সম্ভার যথা স্থানে পরস্পর যুক্ত হইলে উহাকে যেমন রথ বলে, অন্যথা তত্র
তত্র বিক্ষিপ্ত প্রতি অঙ্গাবলোকনে রথ বলিয়া কিছু বোধগম্য হয় না। সেইরূপ নাম-রূপ
পরস্পরাশ্রিত হইলেই মানুষ উহাকে সত্ত্ব, জীব বলিয়া চেতনা লাভ করে। বস্তুত: সত্ত্ব
বা জীব নামক তৃতীয় কোন বস্তুর কল্পনা নিরর্থক। রথেরই মত ব্যবহার মাত্র।
নাম
নিস্তেজ, স্বীয়-শক্তি বলে সে প্রবর্ত্তিত হইতে পারে না। পান-ভোজনে, গমনাগমনে,
অালোকনে-বিলোকনে সে সম্পূর্ণ অসমর্থ। রূপেরও সেই একই গতি। রূপের পান ভোজনের ইচ্ছা
নাই, গমনাগমন কাম্যতাও নাই, আলোকন-বিলোকনেও স্পৃহা শূন্য; কিন্তু পরস্পরকে আশ্রয়
করিয়াই উভয়ের প্রবর্ত্তি ঘটে। নামের পান ভোজনেচ্ছায়, সে রূপের সাহায্যে রূপকেই
পান-ভোজনরূপে ব্যবহার করে। গমনাগমনেচ্ছায়, আলোকন-বিলোকন প্রয়াসে, রূপের সাহায্যেই
সে কায্য সম্পাদন করে। যেমন নৌকাকে আশ্রয় করিয়া লোক সমুদ্র যাত্রা করে, তথা রূপকেই
আশ্রয় করিয়া নাম প্রবর্ত্তিত হয়। অন্যপক্ষে- মানুষের সাহায্য প্রাপ্ত হইয়া নৌকার
সমুদ্র-প্রাপ্তির ন্যায় নামকে আশ্রয় করিয়াই রূপ প্রবর্ত্তিত হইতে সমর্থ। মানুষ ও
নৌকা পরস্পরাশ্রয়ে যেমন উভয়ে সমুদ্রে প্রবেশ করে; নাম-রূপও অন্যমন্যাশ্রিতভাবে
প্রবর্ত্তনের ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং প্রত্যয় (সাহায্য)বিরহিত
হইলে কাহারও প্রবর্ত্তির ক্ষমতা থাকেনা।
আদিকাল
হইতেই নাম-রূপ সত্ত্ব বা জীবরূপে সত্যত: ব্যবহার হইয়া আসিতেছে। বুদ্ধগণ সে গতে
লঙ্ঘন না করিয়া ব্যবহারত: জীব বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। সুতরাং আত্মাও বটে।
আত্মার
লক্ষণ সম্বন্ধে সাধারণের ধারণা:-আত্মা অখন্ড,সত্য, সার, অপরিবর্তন স্বভাব।তাহার
চক্ষু নাই তবু সে দেখে, শ্রোত্র নাই তবু সে শোনে, নাসিকা নাই তবু সে গন্ধানুভব
করে, জিহ্বা নাই তবু তার রস বোধ আছে, কায় নাই কিন্তু স্পর্শানুভূতির ক্ষমতা
সম্পন্ন, কর-চরণ নাই তথাপি গমন-গ্রহণের ক্ষমতা সে রাখে। অতীন্দ্রিয় হইয়াও
সুখ-দু:খের অধিকারী। এই আত্মাই জন্মান্তর গ্রহণের হেতু স্বরূপ ও মুক্ত স্বভাব।
কিন্তু উপাধি পরিব্যাপ্তি বিধায়, সে জীবভাবে ভাবিত। এই উপাধি মায়িক। মায়াপরিপূর্ন
হইলেই সে তদ্ভাব্ (ব্রহ্মভাব্)প্রাপ্ত হয়। এই তদ্ভাবতাই মুক্তি।
বুদ্ধ-ব্যখ্যাত
ব্যবহারিক (সংবৃতি)আত্মা খন্ড, অসার, পরিবর্ত্তনশীল। কিন্তু সর্ব্বেন্দ্রিয়
পরিপূর্ণ। ইন্দ্রিয়গ্রাম দ্বারাই সে দর্শনাদি সকল কায্য সম্পাদন করে।ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য
বস্তুবিষয়ে সুখ, দু:খাদির অনুভূতিও সে পায় এবং সেই আত্মাই জন্মান্তর পথে ধাবিত হয়-
হেতু প্রত্যয়তার মধ্যদিয়া। সে শূন্যতা স্বভাব। সে স্বয়ং এবং তাহার আর যাহা কিছু
সবই উপাধি, সমুদয় উপাধিই মায়িক। কাজেই উপাধি পরিব্যপ্তি তাহার নাই। সুতরাং তদবস্থা
কোথায়? যোগবলে মায়িক-ব্রহ্মভাবে ও ভাবিত হইবার ক্ষমতায় সে পটুতর। এই ব্রহ্মভাব
প্রাপ্তি লৌকিক মুক্তি, লৌকিক জীবনের পরমা শান্তি।নাম-রূপ উপাধি দ্বয়ের মিলনে যে
মিথ্যা আত্মোপলদ্ধি আমাদের হয়, উহার সম্যক পরিচয় ঘটিলে নাম-রূপ পরস্পর বিচ্ছিন্নও
নিরূদ্ধ হয়। নাম-রূপের ঐকান্তিক নিরোধেই রথোপম আত্মা নামক আগন্তুক পদার্থের শ্মশান
হয়। সেই শ্মশানেই ব্রহ্মত্বের অন্তিম উচ্ছেদ সাধিত হয়। এই আত্মাপহিতিই বুদ্ধের
নিব্বার্ণ, বিমুক্তি, বিমোক্ষ, লোকোত্তরা পরমা শান্তি।
বিদর্শন
প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তি নির্ব্বাণে সন্তুষ্ট নহেন। তাঁহারা মনে করেন সুখ-বর্জ্জিত
নির্ব্বাণের আবশ্যকতা কি? যাহার জন্য এত সাধনা, এত কঠোর তপস্যা, অন্তিমে তাহা কি
শূন্যতালিঙ্গনেই পয্যবসিত করিব? সুতরাং ব্রহ্ম-নির্ব্বাণই শ্রেয়:-সাধনার উত্তম
পুরস্কার। কিন্তু ঈদৃশ জ্ঞানীব্যক্তি চিন্তা করেন না যে, সাকার ব্রহ্মত্ব
প্রাপ্তির উপায় ভূতা চতুর্থ সমাপত্তিতেই সুখের অবসান ঘটে। নিরাকার ব্রহ্মে সে
সুখের আশা মোটেই সম্ভব নহে। বিতর্ক-বিচার- প্রীতি-সুখ বর্জ্জিত উপেক্ষা একাগ্রতা
সহিত চতুর্থধ্যান। চতুর্থধ্যানে কেবল উপেক্ষা-একাগ্রতাই বিদ্যমান।
নির্ব্বাণ কোন বস্তু নহে, তাই প্রাপ্তব্যও নহে। অবস্তুতে
প্রার্থনা নাই, সুতরাং উহা অকাম্য, অপ্রার্থনীয়। আমরা সংবৃতি জালে পরিক্ষিপ্ত,
উহার শক্তির বাহিরে সাধারণত: আমরা কিছু কল্পনা করিতে পারি না। এইজন্য নির্বৃতিকেও
প্রাপ্তব্য বলিয়া আমরা প্রার্থনা করিয়া থাকি। কিন্তু নির্ব্বাণ নির্বৃতি স্বভাব।
এই ‘অপ্রবৃত্তি স্বভাব’ কালের দ্বারা অব্যাহত, নিতান্ত
নিশ্চল এবং নির্ব্বিকার। কিন্তু ‘জীব
সংজ্ঞা’ব্যবহার
বিহিত বলিয়াই তথাগত নির্র্ব্বাণ প্র্রাপ্ত হইলেন,তাঁহার শ্রাবকগণ পরিনির্ব্বুত,
ইত্যাকার ব্যবহৃত হয় মাত্র।
“নিব্বাণং নিবৃতি বৃত্তং,
নিব্বাণঞ্চ ন লভ্যতে,
অপ্রবৃত্তেষু
ধর্ম্মেষু যথা পশ্চা তথা পুরে”।
সুখ ও দু:খের
পশ্চাতে শুভাশুভ কর্ম্মের প্রেরণা স্বীকায্য। প্রেরণাই বা বলি কেন? সেই শুভাশুভ
কম্মই বিপাক-চিত্ত কুশলাকুশল চেতনারই পরিণতি, ফুল যেমন ফলে পরিণত লাভ করে সুতরাং
আত্মার অখন্ডতা, পরিণামতা কিরূপে অস্বীকার করা যায়? যাহা অখন্ড, তাহা কুশলাকুশল
ভেদে ভিন্ন হইবে কিরূপে? অভিন্নতায় স্বর্গ-নরকে বা ইতরেতর যোনিতে জন্মান্তর কিরূপে
সম্ভব? বিজ্ঞান সন্ততি হেতু-প্রত্যয়ে প্রবত্তির্ত, মধ্য ব্যক্ত। অতএব, অসার,
অসত্য। জন্ম-জন্মান্তরের কুশলাকুশল ফল ভোগের জন্য, চিত্ত সন্ততি কুশলাকুশল চিত্ত
সমবায়ে সংবদ্ধ অথচ প্রত্যেক চিত্ত বিভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন; সুতরাং প্রতিসন্ধিজনক
চিত্তসমূহ বর্ত্তমান ভবের চ্যুতি-চিত্তের পরই ভবান্তরে প্রতিসন্ধি-চিত্তকে
পুরোভাগে করিয়া নবীন চিত্ত-সন্ততি প্রবর্ত্তিত করে এবং অতীতের কুশলাকুশল
কর্ম্ম-উপস্তম্ভক হইয়া, উহাকে ধাত্রীর মত পোষণ করিয়া প্রবাহ রক্ষা করে।
মরণ ব্যাপার অন্য
কিছু নহে, এক শরীর প্রবাহ হইতে তদবস্থিত মন-প্রবাহের চ্যুতি মাত্র। আর জন্মাধারণ
হইল, অন্য শরীর স্থিত মনপ্রবাহ অন্য শরীর প্রবাহে সমুদিত হওয়া। কিন্তু মনে রাখিতে
হইবে যে একখানা ট্রেন হইতে নামিয়া অন্য ট্রেনে উঠা কিংবা সর্পের চর্ম পরিবর্তনের
ন্যায় পরিবর্ত্তন নহে। যদি এরূপ ভ্রান্ত ধারণায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়, তখন মনে করিতে
হইবে যে অবিদ্যা আমার অন্তরে আত্মার বাসা বুনিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছে। শরীর প্রবাহের
চ্যুতির সঙ্গেই মনপ্রবাহেরও চ্যুতি এবং সঙ্গেই জনক-চিত্তের প্রত্যয়ে নবীন-শরীর
প্রবাহে নবীন-ভবাঙ্গ সহকারে নবীন মন-প্রবাহ প্রবর্ত্তী।
স্থবির
নাগসেনের উক্তি:-
মিলিন্দ- ভদন্ত
নাগসেন, লোক কি সংক্রমণ (জন্ম গ্রহণের জন্য গমন) না করিয়াই পুনর্জন্ম গ্রহণ করে?
নাগসেন- হাঁ মহারাজ,
সংক্রমণ করে না, অথচ পুনর্জন্ম গ্রহণ করে।
মিলিন্দ- ভদন্ত,
সংক্রমণ করে না অথচ পুনজর্ন্ম গ্রহণ করে, উপমা প্রদান করুন।
নাগসেন- যদি কোন
ব্যক্তি এক প্রদীপ হইতে অন্য প্রদীপ দীপ্ত করে, তবে কি মহারাজ, সেই দ্বিতীয় প্রদীপ
প্রথম প্রদীপ হইতে সংক্রান্ত হয়?
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
নাগসেন- মহারাজ!
আপনি কি মনে করিতে পারেন, যখন আপনি বালক ছিলেন তখন কোন শ্লোকাচায্য হইতে শ্লোক
শিক্ষা করিয়াছিলেন?
মিলিন্দ- হাঁ ভদন্ত,
শিক্ষা করিয়াছি।
নগসেন- সেই শ্লোক কি
শ্লোকাচায্যের নিকট হইতে সংক্রান্ত হইয়াছিল?
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
তিনি আমার পূব্বাপর অনেক শিষ্যকে শ্লোক শিক্ষা দিয়াছেন।
নাগসেন-এইরূপই
মহারাজ, সংক্রমণ করে না। অথচ পূনজর্ন্ম গ্রহণ করে।
মিলিন্দ- এমন কোন
জীব আছে কি ভদন্ত, এই শরীর হইতে অন্য শরীরে সংক্রমণ করে?
নাগসেন- না, মহারাজ।
মিলিন্দ- যদি
সংক্রমণকারী কেহ না থাকে, তাহা হইলে সে পাপ হইতে মুক্ত হইবে।
নাগসেন- হাঁ মহারাজ,
যদি সে জন্মগ্রহণ না করিত, পাপ কর্ম্ম হইতে মুক্ত হইত। কিন্তু যেহেতু জন্মগ্রহণ করে
সেজন্য সে পাপ হইতে মুক্ত হইতে পারে না।
মিলিন্দ- উপমা
প্রদান করুন।
নাগসেন-যদি কোন
ব্যক্তি আম চুরি করে এবং তজ্জন্য সে আম্র-স্বামী কর্ত্তৃক অভিযুক্ত হয়, তবে কি
মহারাজ, সে আপনার বিচারে দন্ড প্রাপ্ত হইবে?
মিলিন্দ- হাঁ ভদন্ত,
সে দন্ডনীয়।
নাগসেন- সে ত
মহারাজ, আম্র-স্বামীর ঐ আম চুরি করে নাই- যেগুলি সে রোপন করিয়াছিল। সুতরাং সে কেন
দন্ড প্রাপ্ত হইবে?
মিলিন্দ- ভদন্ত, সে
যে আম্রগুলি রোপন করিয়াছিল ঐগুলিকে আশ্রয় করিয়াই হৃত আম্রগুলির উতপত্তিঅ সেজন্য
আম্র-চোর দন্ডনীয়।
নাগসেন- এইরূপই
মহারাজ, বর্তমান এই নাম-রূপ দ্বারা যে শুভাশুভ কর্ম্ম সম্পাদিত হয়, সেই কর্ম্ম
হইতে সে মুক্ত নহে।
মিলিন্দ- ভদন্ত, বর্তমান
এই নাম-রূপ দ্বারা য়ে কুশলাকুশল কর্ম্ম সম্পাদিত হয় সেই কর্ম্ম সমূহ কোথায় সঞ্চিত
থাকে?
নাগসেন- মহারাজ, যে
সকল বৃক্ষের ফল এখনও অনুতপন্ন, উহা কি দেখাইতে পারা যায় যে-এইখানে বা ঐখানে ফলগুলি
আছে?
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
নাগসেন- এই রূপই
মহারাজ, সন্ততির অবিচ্ছেদ হেতু দেখাইতে পারা যায় না যে- এখানে বা সেখানে আছে।
মিলিন্দ- ভদন্ত
নাগসেন, আত্মা নামক কোন পদার্থ নাই, তবে যে জন্ম-ধারণ করে সে কি সেই, না অন্য?
নাগসেন- সেও নহে,
অন্যও নহে। মহারাজ, যখন আপনি শিশু, নবীন ও উত্তানশায়ী ছিলেন, সেই আপনিই কি এখন বড়
হইয়াছেন?
মিলিন্দ- না, ভদন্ত।
সেই শিশু অন্য, আর এখন বড় হইয়া আমি অন্য।
নাগসেন- মহারাজ,
ইহাই যদি হয় তবে আপনার মাতা-পিতা নাই, আচায্যাদিও কেহ নাই। তবে কি মহারাজ, ভ্রণে
মাতা অন্য, পেশীর মাতা অন্য, শিশুর মাতা অন্য, বড়র মাতা অন্য? অন্য ব্যক্তি শিক্ষা
করে- অন্য ব্যক্তি শিক্ষিত হয়? এক ব্যক্তি পাপ করে- অন্য ব্যক্তির হস্ত পদ ছিন্ন
হয়?
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
কিন্তু আপনাকে এরূপ প্রশ্ন করা হইলে আপনি কি উত্তর প্রদান করিবেন?
নাগসেন- আমি বলিব,
আমি শিশু, নবীন ও উত্তানশায়ী ছিলাম, সেই আমিই এখন বড় হইয়াছি। শরীরকে আশ্রয় করিয়াই
এই সকল অবস্থা একত্র সংগৃহীত হইয়াছে। মহারাজ, যদি কোন প্রদীপ জ্বলে তবে কি উহা
সমস্ত রাত্রি দীপ্ত থাকিবে?
মিলিন্দ- হাঁ ভদন্ত।
নাগসেন- মহারাজ, ঐ
দীপের প্রথম প্রহরে যে শিখা, মধ্য প্রহরেও কি সেই শিখাই?
মিলিন্দ- না, ভদন্ত।
নাগসেন- তবে কি
মহারাজ, প্রথম প্রহরে অন্য প্রদীপ ছিল, মধ্য প্রহরে অন্য, শেষ প্রহরে অন্য?
মিলিন্দ- না, ভদন্ত।
সেই একই প্রদীপকে আশ্রয় করিয়া শিখা সমস্ত রাত্রি প্রদীপ্ত ছিল।
নাগসেন- এই প্রকারই
মহারাজ, ধর্ম্ম-সন্ততি প্রবাহিত হয়। অন্য উতপন্ন হয়, অন্য নিরুদ্ধ হয়। যুগপত
প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে। তজ্জন্য চরম বিজ্ঞানে ইহাই সংগৃহীত হয়, যে উতপন্ন হয়- সে,
সেও নহে, সে অন্যও নহে।
মিলিন্দ- উপমা
প্রদান করুন ভদন্ত।
নাগসেন- যেমন
মহারাজ, সদ্য দুগ্ধ কালান্তরে দধিরূপে পরিবর্ত্তিত হয়। আবার দধি-নবনীতে,
নবনীত-ঘৃতে পরিবর্ত্তিত হয়। এখন যদি কোন ব্যক্তি এইরূপ বলে যে, যাহা দুগ্ধ-তাহাই
দধি, তাহাই নবনীত, আর তাহাই ঘৃত। তবে কি মহারাজ ঠিক বলে?
মিলিন্দ- না, ভদন্ত।
নাগসেন- এইরূপই
মহারাজ, বস্তু-ধর্ম্ম-প্রবাহ বস্তুতে সম্মিলিত হয়। অন্য উতপন্ন হয়, অন্য নিরুদ্ধ
হয়। যাহা নিরুদ্ধ হয়, ঠিক তাহাই উত্হপন্ন
হয় না, কিন্তু নিরুদ্ধমান বস্তুর ধর্ম-প্রবাহ উতপদ্যমান বস্তুতে অপূর্ব্বাপর(যুগপত)সম্মিলিত
হয়। তজ্জন্য চরম বিজ্ঞানে ইহাই সংগৃহীত হয় যে, যে উতপন্ন হয়, সে, সেও নহে- সে
অন্যও নহে।
আত্মা তথা জগত,
ইহাদের কালিক সম্বন্ধ দুইক্ষণ পয্যন্তও স্থিত নহে। পঞ্চ-স্কন্ধ প্রতিক্ষণেই পরিণাম
প্রাপ্ত হইতেছে। ইহা দীপ-শিখা ও দুগ্ধ-সন্ততির দ্বারা বিশদীকৃত হইয়াছে। মানসিক
অনুভুতি তথা প্রবৃত্তি সমূহের অস্তিত্ব অস্বীকায্য নহে।উহার সমুচ্চয় আত্মা। আত্মা
ইহা হইতে ভিন্ন বা বেশী কিছু নহে। এই আত্মা নাম-রথের ন্যায় কেবল ব্যবহারের জন্যই
গ্রহণ করা হইয়াছে। আত্মার বাস্তবসত্ত্বা মোটেই স্বীকায্য নহে। এই অবাস্তব আত্মার
পারলৌকিক সমুতপাদের ইচ্ছাও অবাস্তব। মধ্যমিকেরা বলেন- “না বাহ্যর্থ আছে, না বিজ্ঞান আছে
প্রত্যুত শূন্যই পরমার্থ। এই চরাচর বিশ্বের সত্ত্বা প্রতিভাসিক (ব্যবহারিক)”। শূন্যতা অর্থ-“অস্তি, নাস্তিম তদুভয়ং, নোভয়ং”।এই চতুষ্কোটি বিমুক্ত। যাহা
অনিরব্বচনীয় তাহাই শূন্য। বস্তু ঐকান্তিক সতও নহে, অসতও নহে। প্রত্যুত উহার স্বরূপ
এই উভয় সদাসতের মধ্য-বিন্দুতেই নির্ণিত হইতে পারে-যাহা স্বয়ং শূন্য রূপই হইবে। এই
শূন্য অভাব হইতেএকেবারে স্বতন্ত্র। কারণ অভাবের কল্পনা সাপেক্ষ কল্পনা; পরন্ত এই
শূন্য নিরপেক্ষ পরম সত্ত্বার সূচক। এই শূন্যই সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্ব। এই সমস্ত
নানাত্মক প্রপঞ্চ শূন্যেরই প্রতিপক্ষ।-
“অস্তী’তি
নাস্তী’তি উভোপি অন্তা
শুদ্ধি অশুদ্ধি’তি
ইমেপি অন্তা
তস্মাদ্দুভে বিবর্জ্জয়িত্বা
মধ্যহি স্থানং প্রকরোতি পন্ডিত:”।
----সমাধিরাজ সুত্র
এই
শূন্য বুদ্ধির অগোচর। বুদ্ধি মাত্রই বিকল্পাত্মক। বিকল্প অবস্তুগ্রাহী হওয়াতে
অবিদ্যাত্মক। বুদ্ধিতে এত যোগ্যতা নাই যে, সে পরমার্থ
সত্যকে যথার্থভাবে গ্রহণ করিতে পারে। অবিদ্যা স্বভাব দর্শনের আবরণ তথা অসত
পদার্থের স্বরূপের আরোপণকারিণী।–
“বিজ্জমানং
অবিজ্জাপেতি
অবিজ্জমানং বিজ্জাপেতী’তি
অবিজ্জা”।
সংবৃতি বা ব্যবহার দুই প্রকার- (১) তথ্য
সংবৃতি-যখন আমি প্রত্যক্ষদৃষ্ট ঘট-পটাদি বিষয় সমূহকে অদুষ্ট ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ
করিয়া থাকি তখন উহাকে তথ্য-সংবৃতি বলা হয়। উহাকে লৌকিক দৃষ্টিতে সত্য মানা যায়।
(২) মিথ্যা সংবৃতি- যখন মরীচিকাদি দুষ্ট ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করা যায় তখন উহাকে
ব্যবহারিক দৃষ্টিতে মিথ্যা বলা যায়। আয্যসত্য চতুষ্টয়ের প্রথম, দ্বিতীয়্ ও চতুর্থ
সত্যত্রয় সংবৃতি স্বভাব বলিয়া সাম্বৃতিক সত্যর অন্তর্গত কেবল নিরোধ সত্যই লোকোত্তর
সত্য।এই উভয় সত্যের আধারে তথাগত মানব সমাজে উপদেশ প্রদান করেন। লোকোত্তর সত্য
অদ্বৈত পরমার্থ সত্য। ইহা অবিদ্যা দ্বারা অষ্পৃষ্ট হওয়াতে ক্লেশাবরণ ও জ্ঞানাবরণ
বিমুক্ত।
ভাব না স্বত: উতপন্ন হয়, না পরত: (অন্য
কারণে), না উভয়ত: না অহেতুত: উতপন্ন হয়। যদি স্বত: উতপন্ন হয় তবে যে পদার্থ
বিদ্যমান আছে উহার উতপত্তির প্রয়োজন কি?নিজ হইতে স্বজাতীয় পদার্থ ভিন্ন অন্য বস্তু
কি উতপন্ন হইতে পারে? উভয় পক্ষে দোষ হওয়াতে ইহার সমুচ্চয় ঠিক নহে। বিনা হেতুতেই
কায্য উতপন্ন হয় ইহাও ঠিক নহে। কেননা কায্য-কারণ-নীতির সিদ্ধান্ত মাননীয়। নতুবা সব
পদার্থ হইতে বিজাতীয় সব পদার্থ উতপন্ন হইতে থাকিবে।
“ন স্বতো নাপি পরতো ন দ্বাভ্যম্ নাপা
হেতুতো,
উত্পন্না জাতু বিদ্যন্তে ভাবাঃ ক্কচন কেচন”।
রূপ, বেদনাদি স্কন্ধ-পঞ্চ চির অনিত্য। ইহা
বর্তমানে যেমন কায্য-কারণ-নীতি জাত আমরা দেখিতে পাই, এ স্বভাব ইহার অতীতেও ছিল
ভবিষ্যতেও থাকিবে। যাহা অনিত্য তাহা দুঃখোদ্রেককর, যাহা দুঃখোদ্রেককর তাহা পর
স্বভাব; সুতরাং অনাত্নন।
যদি কেহ বলে –বেদনা
আমার আত্মা, তাহা হইলে সে উদয়-ব্যয় স্বভাব আত্মাই স্বীকার করিল। বেদনা-সুখ, দুঃখ ও
অদুঃখ-অসুখ ভেদে ত্রিধা বিভক্ত। যখন সুখ-বেদনা আমরা পাই তত্সংগে অন্য বেদনাদ্বয়ের
অনুভূতি আমাদের হয় না। যখন দুঃখ বেদনা অনুভব করি তখন অন্য বেদনাদ্বয় আমাদের
অনুভূতিতে আসে না। আবার যখন অদুঃখ-অসুখ বেদনার অনুভূতি আমরা পাই তখন সুখ-দুঃখ এই
বেদনাদ্বয় আমাদের থাকেনা। প্রত্যেক বেদনা নিজকে সম্পূর্ণ একক ভাবেই প্রকাশিত করে।
যে বেদনাত্রয় পরস্পর অবিমিশ্র স্বভাব এবং প্রত্যেকের স্বভাবই উদয়-ব্যয় রূপে সচরাচর
অনুভব করিতেছি তাহাকে নিত্য ও অখন্ড রূপে কী করিয়া মানিয়া লইতে পারি? যেই বেদনার
যখন সমুদয় হয় তাহাকে আমরা স্পষ্টতঃ তখন জানিতে পারি যে এইরূপ বেদনা আমার হইল। যদি
বেদনাই আত্মা হয়, তবে বলিতে হইবে যে আত্মা উদয়-ব্যয়শীল।
আবার যদি কেহ বলে- বেদনা আমার আত্মা নহে;
আত্মার অনুভূতি নাই, তবে জিজ্ঞাস্য এই যে, যাহার কোন অনুভূতি নাই তাহার পক্ষে কি
এরূপ অনুভব হওয়া সম্ভব যে আমি এই আত্মা? আবার যদি কেহ বলে- না, বেদনা আমার আত্মা,
না আমার আত্মার অনুভূতি হয়; কিন্তু আত্মার স্বভাবই বেদনা। তাহা হইলে জিজ্ঞাস্য-
সমুদয় বেদনার যখন নিরোধ হয়- কোন প্রকার বেদনাই আর থাকে না (যেহেতু বেদনা
উদয়-ব্যয়শীল প্রমাণিত হইয়াছে), তখনো আত্মা অনুভব করিতে পারে কি যে আমিই আত্মা? যদি
স্বভাব উদয়-ব্যয়শীল হয় তবে স্বভাবী উদয়-ব্যয়শীল; সুতরাং বিপরিণামী, অনিত্য ও অসার।
যেমন বেদনা অনাত্মা, তেমনই মন কিম্বা মনোবিজ্ঞান ও সমধর্ম্মী অর্থাত্ত্ত প্রত্যয়
জাত এবং উদয়-ব্যয়শীল বলিয়া অনাত্মা। সংজ্ঞা, সংস্কারাদিও বেদনারই মত চৈতসিক বিশেষ।
সুতরাং এসমুদয়ও অনাত্মা। তবে আত্মা কাহাকে বলিব? ইহারা যদি প্রকাশিত হয়, তবে
প্রত্যয় যোগেই প্রকাশিত হয়, অপ্রত্যয়ে নিরুদ্ধ বা অনু্থপন্নই থাকে। তখন ষষ্ঠ
স্থানীয় কিছুরই উপলদ্ধি হয়না।
চিত্ত –সন্ততির চিত্ত বীথি (পরিক্রমণ মার্গ)
ভ্রমণের পর ভবাঙ্গে পতিত হয়। ভবাঙ্গে চিত্তটিই যেন চিত্তের বীথি ভ্রমণ কালে
বীথি-চিত্তরূপ ধারণ করে তখন উহা সমল। এই সমল চিত্তটাই যেন জীব, আর ভবাঙ্গ চিত্তটি
যখন নিম্মর্ল থাকে যেন আত্মা। এইরূপ ভ্রমের কারণ আছে।–
“চিত্তং
ভিক্খবে পভস্সরং, আগন্তুকেহি ধম্মেহি
চিত্তং কিলিট্ঠং ভবতি’’।
এই প্রভাস্বর চিত্ত ভবাঙ্গ চিত্তকেই
নির্দ্দেশ করিতেছে। তরঙ্গহীন নদী-স্রোতের ন্যায় ভবাঙ্গ-স্রোত শান্তভাবে প্রবাহমান।
কিন্তু বাত-ক্ষিপ্ত নদী যেমন তরঙ্গায়িত হয় তেমনই ইন্দ্রিয় গ্রাম বিষয় সমূহের
অভিঘাত প্রাপ্ত হইয়া ভবাঙ্গ সন্ততিতে সমল চিত্তো্ত্পত্তি করায়। নবালম্বন স্পর্শে
ভবাঙ্গ নিজ আলম্বন পরিহার করিয়া নবোত্ত্তপন্ন চিত্তের আলম্বন গ্রহণ করে। এই নবীন
আলম্বন মননকেই নবচিত্তের উতপত্তি হইল বলিয়া বলা হয়। স্বীয় চৈতসিকে ভবাঙ্গ সদাশুদ্ধ।
লোভ, দ্বেষ, মোহের স্পর্শ উহাতে নাই। আদর্শে লাল-নীলাদির ছায়া পতনে তদাকার ধারণ
করার ন্যায় অন্য চৈতসিক সংযোগে ভবাঙ্গও তদাকার ধারণ করে। যখন চিত্তে শ্রদ্ধা
চৈতসিক উৎপন্ন হইল তখন চিত্তকেই আমরা শ্রদ্ধাচিত্ত বলিয়া অভিহিত করি।
বস্তুতঃ আদর্শের যেমন কোন পরিবর্তন ঘটে না
তেমনই ভবাঙ্গে শুদ্ধতার অপচয় পরিলক্ষিত হয় না। এই ভবাঙ্গ চিত্তকেই যদি আত্মা বলা
হয়, তবে তাহাকে দ্রষ্টারই মত বলা যাইতে পারে। কেননা ভবাঙ্গ চিত্তের ও চৈতসিক রহিয়াছে- স্পর্শ, বেদনা, সংজ্ঞা,
চেতনা, একাগ্রতা, মনষ্কার,জীবেতেন্দ্রীয় প্রভৃতি।
চলমান>>>>>>>>>>-------------
বিষয়টি জটিল বোধ হইল। আরও সরল করিয়া উপস্হাপিত হইলে বোধগম্য হইত বোধ হয়।
উত্তরমুছুন