লেখক: বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির
বইয়ের নাম: সত্য দর্শন
আমরা বলি, আমার শরীর, আমার জ্ঞান-ধ্যান, আমি সুখ-দু:খ অনুভব করি, আমি দেখি-শুনি, আমার দ্বারা ঘ্রাণন-স্বাদন-দর্শন-স্পর্শন কারয্য সমাপাদিত হয়। চিরাগত প্রশ্ন হইতেছে,- এই শরীরের অধিকারী কে? এই যে তথাকথিত আমি সে কে?
বইয়ের নাম: সত্য দর্শন
আমরা বলি, আমার শরীর, আমার জ্ঞান-ধ্যান, আমি সুখ-দু:খ অনুভব করি, আমি দেখি-শুনি, আমার দ্বারা ঘ্রাণন-স্বাদন-দর্শন-স্পর্শন কারয্য সমাপাদিত হয়। চিরাগত প্রশ্ন হইতেছে,- এই শরীরের অধিকারী কে? এই যে তথাকথিত আমি সে কে?
প্রাচীন কাল হইতেই
দার্শনিকগণ এই সব প্রশ্নের বিচার করিয়া আসিতেছেন, এই আমি কে?প্রশ্ন খুব সহজ,
উত্তরও সরল বলিয়াই আমাদের ধারণা। আমরা মনেকরি আমার শরীর, আমার চক্ষু-কর্ণাদি বলিতে
এখানে না বুঝিবার কি আছে? কিন্তু আসলে তাহা নহে। প্রশ্নটি স্বভাব-গম্ভীর। এইজন্য
দার্শনিকগণ বিভিন্ন মত পোষণ করিয়াছেন ও ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিয়াছেন।
কেহ কেহ বলেন- ব্যক্তির পশ্চাতে এমন এক সত্তা আছে, যিনি
শরীরের কর্ত্তা, জ্ঞানের জ্ঞাতা, সুখ-দু:খের ভোক্তা, দ্রষ্টা, ঘ্রাতা, স্বাদেতা,
স্পর্শেতা, ইনিই হইতেছেন আমাদের আত্মা। কেহ বলিয়াছেন পুরুষ, কেহ বলিয়াছেন জীব। কিন্তু
এই শ্রেণীর ভিন্নতায় কিছু আসিয়া যায় না। সকলে একটি কিছু লক্ষ্য করিয়াছেন, ইহা
একান্ত সত্য। এই আত্মাই শরীর ও মনের পরিচালক। জানন, ভোজন, দর্শন, স্পর্শন,ধারণ
গমনাদি জ্ঞান ও কর্ম্মেন্দ্রিয় গ্রামের সাহায্যেই তিনি সম্পাদন করিয়া থাকেন।
আত্মা, মন ও শরীরের পরে।মন ও শরীরের তিনি একমাত্র কর্ত্তা ও সর্বেসব্বা।
এই মতবাদে আজও
পৃথিবীর বহু বিজ্ঞাবিজ্ঞ লোক প্রতিষ্ঠিত। তথাগত
বুদ্ধ্বই সর্ব্ব প্রথম এই মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি অনাত্মাবাদী,
সন্ততিবাদী। একদা পৃথিবী এই অনাত্মবাদকে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে গ্রহণ করিয়াছিল। আজও
অনাত্মবাদীর সংখ্যা তুল্য তুল্য বলিতে হইবে।
জাতিস্মর
জ্ঞান ও সংক্রমণ স্বীকার না করিয়া আপাতত: কিরূপে পারা যায়? কিন্তু
আত্মার(বিজ্ঞানের) ভিন্ন দেহ সংক্রান্তি অস্বীকার করিয়া তথাগত “সাতি” নামক ভিক্ষুকে তিরষ্কার
করিয়াছিলেন। তাঁহার মত এই য়ে,- বিজ্ঞান তথাকথিত আত্মা ও প্রতীত্য সমুতপন্ন ধর্ম্ম।
প্রত্যয় ভিন্ন বিজ্ঞানের উতপত্তি অসম্ভব।
বহু জলানুর স্রোতরূপে প্রবাহমান সন্ততিকে যেমন আমরা নদী বলি, বহু বিজ্ঞানের
সন্ততিকে তেমনই আত্মারূপে সাধারণভাবে আমরা গ্রহণ করিয়াছি। জলানুর স্রোতই সত্য,
নদী ব্যবহার মাত্র। আত্মাও ব্যবহার মাত্র, বিজ্ঞান সন্ততিই সত্য। যাজ্ঞবল্ক্য
আত্মাকে ইহ পর জন্মের সেতু রূপে বর্ণনা করিয়াছেন, কিন্তু তথাগত কর্ম্মকেই সেতুরূপে
স্থাপন করিয়াছেন। দীপ্ত দীপ হইতে, অন্য অদীপ্ত দীপ দীপ্ত করিলে যেমন পূর্ব্ব
দীপ্তির সংক্রমন হয় না, অথবা গুরু হইতে ছাত্র মন্ত্র শিক্ষা করিলে, যেমন গুরু
মন্ত্রহীন হন না, তদ্রুপ আত্মার (বিজ্ঞানের) সংক্রান্তি না হইলেও সংষ্কার-প্রত্যয়
লাভে, পরজন্মে উহার অস্তিত্বের বিকাশ হয়। সে আত্মা (বিজ্ঞান) সেও নহে, পূর্ব্ব
বিজ্ঞানকেই (আত্মাকেই) অবলম্বন করিয়া পর
বিজ্ঞান সম্ভব হইয়াছে।
বেদান্ত
দর্শনে কারণ শরীরের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এই কারণ শরীর যদি ভবাঙ্গ চিত্তই হয়,
তবে বিশেষ গোলে পড়িতে হয় না। ভবাঙ্গ অন্যান্য চিত্তের ন্যায় সক্রিয় নহে। ইহা অতি
সুক্ষ্ম স্পর্শ-বেদনা-সংজ্ঞা-চেতনা-একাগ্রতা-মনষ্কার জীবেতেন্দ্রিয় ও অন্যান্য
চৈতসিক সম্পর্কিত। ভবাঙ্গের একমাত্র প্রকাশ সুসুপ্তি। সমুদয় চিত্ত মহুর্মুহু
উতপন্ন হইয়া বিলয় প্রাপ্ত হইতেছে।প্রতি চিত্তই কিন্তু অভিনব। কিন্তু ভবাঙ্গ জন্ম
হইতে মৃত্যু পযর্ন্ত প্রতিচিত্ত বীথির আদিতে ও অন্তে সমুদিত হইয়া চিত্তোতপত্তির
অবকাশ প্রদান করিয়া থাকে; কিন্তু সে স্বয়ং পুরাতন সদৃশ, অভিনবত্ব তাহার নাই। পুনর্জন্মেই
সে অভিনব হয়, জীবের কৃতকর্ম্মানুসারে। যদি এই কারণ শরীর , কর্ম্ম-কারণ জাতীয় হয়
তবে বৈদান্তিক আত্মা বৌদ্ধ বিজ্ঞান সন্ততির রূপ ধারণ করে এবং উভয় জাতীয় আত্মার কোন
ভেদ থাকে না। ব্রহ্মবাদেও না। ভেদ থাকিয়া যায় মুক্তি বিমুক্তির মধ্যে। বেদান্তে
ব্রহ্ম বৈলিন্যই মুক্তি, এরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে। তথাগত উহা সায়ুক, সসীম মুক্তি
মাত্র বলিয়া, বিজ্ঞান সন্ততির প্রবাহ ছিন্নকেই বিমুক্তিরূপে দেখাইয়াছেন। সইচ বিকল
হইলে যেমন বিজলী ধারা রুদ্ধ হয় এবং তত্ সঙ্গেই বাতি নিভিয়া যায়, এইরূপ বিজ্ঞান
সন্ততি বিকল হইয়া গেলে তৃঞ্চাধারাও রুদ্ধ হইয়া যায়। তৃঞ্চার নিরোধে আত্মারূপ
জীবনদীপ চিরতরে নিবৃত্ত হয়।
তথাগত
বুদ্ধ কিরূপে বহুজনে প্রতিষ্ঠিত আত্মবাদ খন্ডন করিয়াছিলেন, মহাপন্ডিত গ্রীকরাজ
মিলিন্দের প্রশ্নে ও বিচিত্রবাদী মহাভিজ্ঞ স্থবির নাগসেনের উত্তরে, স্পষ্টানুভূতি
পাওয়া যাইবে। চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ সাধারণত: ঈশ্বর-অনীশ্বর আত্মা-অনাত্মা বিষয়েই প্রথমে
চিন্তা করিয়া থাকেন। ইহা যেন একান্ত স্বাভাবিক। মহারাজ মিলিন্দও প্রথমে প্রশ্নে
উহাই গ্রহণ করিয়াছিলেন:-
মিলিন্দ-
ভন্তে! আপনি কিরূপে জ্ঞাত হইয়া থাকেন? আপনার নাম কি?
নাগসেন-
মহারাজ! আমি নাগসেন বলিয়া জ্ঞাত, নাগসেন কিন্তু সংজ্ঞা প্রকাশ ব্যবহার ও নাম
মাত্র, এখানে কোন ব্যক্তি বা অবযবী উপলদ্ধি হয় না।
মিলিন্দ-
যদি ভন্তে ব্যক্তি না থাকে, তবে কে আপনাকে চীবরাদি ও চতুষ্টয় দান করে, কে উপভোগ
করে, কে ভাবনা অভ্যাস করে, কে মাগর্ফল প্রত্যক্ষ করে,কে প্র্রাণী হত্যাদি পঞ্চ
অকুশল কর্ম সম্পাদন করে? তাহা হইলে কুশল নাই, অকুশল নাই, কুশলাকুশলের কর্ত্তা নাই,
কারয়িতা নাই, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফলও নাই।আপনাকে যদি কেহ হত্যা করে তাহা হইলেও
হত্যাকারীর কোন পাপ হইবে না। আপনার আচায্য নাই, উপাধ্যায় নাই, উপসম্পদাও নাই। আপনি
যাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন যে মহারাজ! আমি নাগসেন বলিয়া জ্ঞাত। এখানে সেই নাগসেন
কে? ভদন্ত! কেশগুলি কি নাগসেন?
নাগসেন-
না মহারাজ।
মিলিন্দ-
লোম, নখ, দন্ত, ত্বক, মাংস নাগসেন?
নাগসেন-
না মহারাজ।
মিলিন্দ-
রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংষ্কার, বিজ্ঞান নাগসেন?
নাগসেন-
না, না, না মহারাজ।
মিলিন্দ-
তবে কি ভন্তে! রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংষ্কার, বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টিরূপে
নাগসেন?
নগসেন-
না, মহারাজ।
মিলিন্দ-
ভদন্ত! আপনাকে জিজ্ঞাসা করিয়া করিয়া নগসেনকে পাইলাম না। নাগসেন কি তবে শুধু শব্দই?
বিদ্যমান নাগসেন কে তবে? আপনি মিথ্যা বলিয়াছেন, নাগসেন নাই।
নাগসেন-
মহারাজ, আপনি ক্ষত্রিয়-কুমার, সুকোমল শরীর আপনার, মধ্যাহ্ন সময় এখন, ভূমি তপ্ত,
উঞ্চ বালুকার উপর তীক্ষ্ম কাঁকর, ভগ্ন মৃৎপাত্র সমূহ মর্দন করিয়া পদব্রজে আসায়
সম্ভবত: আপনার চরণ উপহত হইয়াছে, শরীরও বোধহয় ক্লান্ত হইয়াছে?
মিলিন্দ- আমি রথে করিয়া আসিয়াছি ভন্তে,
আমার বিন্দুমাত্র ক্লান্তি হয় নাই।
নাগসেন- মহারাজ আপনি যদি রথে আসিয়া থাকেন,
তবে রথ কি তা আমাকে বলুন। ঈশা কি রথ?
মিলিন্দ- না ভদন্ত।
নাগসেন- অক্ষ, চক্র, পঞ্জর, দন্ড, রজ্জু,
প্রতোদ দন্ড কি রথ?
মিলিন্দ-না,না,না ...ভদন্ত।
নাগসেন-তবে কি মহারাজ ঐগুলির সমষ্টিরূপে
রথ?
মিলিন্দ-না ভদন্ত।
নাগসেন- আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিয়া করিয়া
হয়রাণ হইলাম, অথচ রথ দেখিতে পাইতেছি না। মহারাজ, রথ কি তবে কেবল শব্দমাত্র? তবে
এখানে বিদ্যমান রথ কি?আপনি মিথ্যা বলিয়াছেন, এখানে রথ নাই।
মিলিন্দ- ভদন্ত! আমি মিথ্যা বলি নাই। ঈশা
চক্রাদির সমবায়ে সুসংবদ্ধতা হেতু রথ। ইহা সংজ্ঞা প্রকাশ, ব্যবস্থারও নাম মাত্র।
নাগসেন- সাধু, সাধু, মহারাজ রথ কি তাহা
আপনি ভাল জানেন। ঠিক এইরূপই মহারাজ! কেশ-লোমাদি রূপ এবং
বেদনা-সংজ্ঞা-সংষ্কার-বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধ হেতুই নাগসেন। এইগুলিকে আশ্রয় করিয়াই
নাগসেন সংজ্ঞা, ব্যবহার, প্রকাশ ও নাম মাত্র প্রবর্ত্তিত হইতেছে। পরমাথর্ত: এখানে
পৃথক কোন ব্যক্তি বা অবয়বীস্বরূপ লোকের বা আত্মার উপলদ্ধি হয় না।
মিলিন্দ- সাধু, সাধু, ভন্তে নাগসেন, অতি
সুন্দর ও বিচিত্র রূপে আপনি উত্তর প্রদান
করিয়াছেন।
মন্ত্রী অনন্তকায়ের প্রশ্ন
অনন্তকায়- ভদন্ত নাগসেন! এই যাহাকে আমি
নাগসেন বলিতেছি, সেই নাগসেন এখানে কে?
নাগসেন- আপনি কাহাকে নাগসেন মনে করেন?
অনন্তকায়- আমি মনেকরি যে, সেই অভ্যন্তরস্থ
বায়ুই নাগসেন; যাহা প্রবেশ করিতেছে আর নিষ্ক্রান্ত হইতেছে।
নাগসেন- যদি এই বায়ু নিষ্ক্রান্ত হইয়া আর
প্রবেশ না করে, অথবা প্রবেশ করিয়া আর নিষ্ক্রান্ত না হয়, তবে কি সেই পুরুষ জীবিত
থাকিবে?
অনন্তকায়- না ভদন্ত।
নাগসেন- এই য়ে শঙ্ক বাদকেরা শঙ্ক বাদন করে,
সেই বায়ু কি তাহাদের মধ্যে পুনরবার প্রবেশ করে?
অনন্তকায়- না ভদন্ত।
নাগসেন-তাহা হইলে শঙ্ক বাদকেরা মরে না কেন?
অনন্তকায়- আপনি বাদী, বিচারশীল, আপনার সহিত
আলাপ করিতে আমি অসমর্থ।
ভাল ভদন্ত, এখানে তত্ত্ব কথা কি তাহা আপনি
আমাকে বলুন।
নাগসেন- বায়ু ঝীব নহে, ইহা আশ্বাস-
প্রশ্বাস, শরীরের ধর্ম্ম।